বিকাল ৫:৪৬, ২৮শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
কুমিল্লা প্রতিনিধি : চোখে দেখেন না, কানেও শোনেন না। আছে শ্বাসকষ্ট আর পেটে পাথর। বয়স ৬৫ বছর। তবুও এসব বাধা পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন রমেশ চন্দ্র মজুমদার। আন্দাজ করে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে গাছি হিসেবে কাজ করেন তিনি। এই অন্ধ-বধির মানুষটিই গাছ পরিষ্কার করে সংসার চালান।
রমেশ চন্দ্র মজুমদার কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মালীগাঁও ইউনিয়নের চাপাতলী গ্রামের বাসিন্দা। স্ত্রী তুলসী মজুমদারকে নিয়ে তার ছোট সংসার। মালীগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় তালগাছ ও নারিকেল গাছ পরিষ্কারের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজই তার জীবিকার মাধ্যম। ভিক্ষা ভালো না লাগায় দৃষ্টি হারিয়েও পরিশ্রম বেছে নিয়েছেন রমেশ।
রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে রমেশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনের ঘরে বসবাস করেন রমেশ-তুলসী দম্পতি। মানুষের গাছ পরিষ্কার করার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত কাজও নিজেই করেন রমেশ।
প্রতিবেশিদের জানান, বহু বছর আগে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারান রমেশ। তারপর থেকেই তিনি নিরুপায় হয়ে পড়েন। কাজ করতে ভালোবাসেন বলেই বেছে নেন গাছ পরিষ্কারের ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি।
সংসারে রমেশ এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। একমাত্র ছেলে আগে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, কিছুদিন আগে সৌদি আরবে গেছেন। তবে এখনও কাজ পাননি। প্রায় ৮ লাখ টাকা ঋণে জর্জরিত এই পরিবার এখন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল অন্ধ রমেশের আয়ের ওপর।
প্রতিদিন সকালে কাঁধে গাট্টি বেঁধে হাফপ্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়েন রমেশ। আন্দাজ করে আশপাশের গ্রামগুলোতে যান। গাট্টিতে থাকে কয়েকটি রশি, একটি ছোট লাঠি, কাস্তে আর ধারালো ছেনি। কানের কাছে জোরে বললে কথাবার্তা বুঝতে পারেন তিনি। গাছ পরিষ্কারের জন্য প্রতি গাছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত পান রমেশ। দিনে সর্বোচ্চ চারটি গাছ পরিষ্কার করেন। আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা, যা দিয়েই সংসার ও ঋণের কিস্তি চালাতে হয়। আগে তালগাছ ও নারিকেল গাছ দুই-ই পরিষ্কার করলেও এখন কেবল নারিকেল গাছেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
গত কয়েক বছর আগে রমেশের পেটে পাথর ধরা পড়ে, কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তার ঘরের ছাদে অসংখ্য ফুটো, সামান্য বৃষ্টিতেই ভেতরে পানি পড়ে। সরকারি সুবিধা হিসেবে পান শুধু প্রতিবন্ধী ভাতা।
প্রতিবেশিদের দাবি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি ঘর পেলে রমেশের পরিবার উপকৃত হতো। পাশাপাশি চিকিৎসার খরচের জন্য আর্থিক সহায়তাও প্রয়োজন। তারা সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা চেয়েছেন।
রমেশের স্ত্রী তুলসী মজুমদার বলেন, বিয়ের পর অনেক চেষ্টা করেছি ওনার চোখের চিকিৎসা করাতে, কিন্তু খরচ অনেক বেশি হওয়ায় পারিনি। এখন পেটে পাথর হয়েছে, টাকার অভাবে চিকিৎসাও হচ্ছে না। সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকি। সকালে বের হলে মন কেমন করে থাকে, কখন ফিরবে এই ভেবে। সরকারের কাছে মানুষটার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চাই।
প্রতিবেশি তপন মজুমদার বলেন, রমেশ মজুমদার আমার কাকা। ছোটবেলা থেকেই দেখি আন্দাজ করে হাঁটেন, গাছে উঠে পরিষ্কার করেন। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সরকার একটু খেয়াল করলে এই অন্ধ মানুষটার অনেক উপকার হতো।
রমেশের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুশীলা মজুমদার বলেন, মেয়েদের বিয়ে দিতে আর ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে অনেক টাকা ঋণ করেছেন। এখন সব বোঝা ওনার ওপর। অনেক সময় লোকজন দুষ্টুমি করে ভুল পথে পাঠিয়ে দেয়, তখন সঠিক পথ খুঁজে ফিরতে সারাদিন লেগে যায়। সরকার যদি একটু সহায়তা দিত, অনেক উপকার হতো।
অন্ধ রমেশ মজুমদার বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে গাছির কাজ করছি। কাজ না করলে সংসার চলবে কীভাবে? ভিক্ষা করা পছন্দ না। এখন শরীরে আগের মতো শক্তি নেই, গাছে উঠতে কষ্ট হয়, তবু কাজ করি না করলে খাওয়াবে কে?
দাউদকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাছরিন আক্তারকে দুই দিন ধরে ফোনে পাওয়া যায়নি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ঢাকায় মিটিংয়ে আছেন।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেদওয়ান ইসলাম বলেন, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপজেলা ফান্ড থেকে এককালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। পাশাপাশি জেলা কার্যালয় থেকেও সহযোগিতার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।