রাত ১০:৪৯, ২রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : শীতের আগমনী বার্তা আর মাটির গন্ধে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁও শহর। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী পণ্যের প্রদর্শনী এবং শীতের আগমনী পিঠা মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলার উদ্বোধন করেন ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা।
রোববার (২ নভেম্বর) বিকেলে জেলা শহরের ডিসি পর্যটন পার্কে এই আয়োজন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দিনব্যাপী এই আয়োজনে ছিল স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর মানুষের আনন্দের মিলনমেলা। শতাধিক মৃৎশিল্পী ও নারী উদ্যোক্তা নিজেদের তৈরি নান্দনিক পণ্য ও পিঠা-পায়েস নিয়ে অংশ নেন মেলায়।
ডিসি পর্যটন পার্কের মাঠজুড়ে সাজানো স্টলগুলোতে ছিল নানা আকৃতির ফুলদানী, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, প্রদীপ, খেলনা, গৃহসজ্জার উপকরণসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্য। হাতে তৈরি প্রতিটি জিনিসে ফুটে উঠেছে শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্যের ছাপ। দর্শনার্থীরা কেউ ছবি তুলেছেন, কেউবা কিনে নিয়েছেন পছন্দের পণ্য। মেলায় অংশ নেয় স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
পাশাপাশি, পিঠা মেলায় ছিল একেবারে গ্রামীণ স্বাদ। দুধচিড়ার ঘ্রাণ, পাটিসাপটার মিষ্টি রস আর খেজুরের গুড়ের সুবাসে চারদিক মুখরিত। জেলার বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তা ও সংগঠন পিঠার স্টল সাজিয়েছেন নিজেদের মতো করে। দিনের শেষে সূর্য যখন ডিসি পার্কের গাছের মাথায় হেলে পড়েছে, তখনও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল অটুট। কেউ ব্যস্ত পিঠার স্বাদ নিতে, কেউ মাটির পণ্য হাতে নিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলছেন। সেই হাসিই যেন জানিয়ে দিচ্ছিল ঐতিহ্য এখনো মরে যায়নি, শুধু একটু যত্ন আর উদ্যোগই পারে তাকে নতুন প্রাণ দিতে।
মেলায় আগত দর্শনার্থী নূর আলম বলেন, এমন আয়োজন আমাদের গ্রামের পুরনো দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। মাটির জিনিসের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রদর্শনী সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
সদর উপজেলার আকচা পালপাড়ার মৃৎশিল্পী সুবোধ পাল জানান, আমরা প্রজন্ম ধরে মাটি দিয়ে কাজ করছি। একসময় বাড়ি বাড়ি মাটির হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া রান্নাই হতো না। এখন সেই দিন আর নেই। তবু এই মেলায় এসে মনে হচ্ছে মানুষ এখনো মাটির জিনিস ভালোবাসে। বিক্রিও বেশ ভালো হচ্ছে। প্রশাসন যদি এমন আয়োজন নিয়মিত করে, তাহলে এই পেশায় আবারও টিকে থাকা সম্ভব।
আরেক মৃৎশিল্পী মালতি রানী পাল বলেন, আমাদের এই শিল্প এখন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ে, কিন্তু জিনিস বিক্রির দাম বাড়ে না। তবু আজকের এই মেলায় বেশ বিক্রি হয়েছে, মানুষ প্রশংসা করছে। নতুন করে কাজের উৎসাহ পেয়েছি।
আরেক বিক্রেতা পুলিন পাল বলেন, বাচ্চারা এসে মাটির পুতুল হাতে নিচ্ছে, কেউ ছবি তুলছে। ওদের মুখের হাসিটাই আমার লাভ। বিক্রি যতটুকুই হোক, এমন প্রশংসা পেলে মন ভরে যায়। তবে একদিন ব্যাপী না করে এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের আয়োজন করলে ভালো হতো। একদিনে আসলে বিক্রি হয় না। অনেক মানুষ মেলায় আসতে পারে না।
নারী উদ্যোক্তা নাসিমা আক্তার বলেন, আমি নিজের হাতে পাটিসাপটা, চিতই আর ভাপা পিঠা বানিয়েছি। আগে শুধু বাড়ির জন্য করতাম, এখন বিক্রি করে আয়ও হচ্ছে। মানুষ আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে, দামও জিজ্ঞেস করছে এইটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।
আরেক উদ্যোক্তা তামান্না বলেন, মেলায় এমন পরিবেশে পিঠা বিক্রি করা আনন্দের। লোকজন এসে বলছে, এই পিঠার স্বাদ ছোটবেলার মতো। এই কথাই সব পরিশ্রমের দাম দেয়।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাফিদ করিম বলেন, আমরা এখন বইয়ে পড়ে ঐতিহ্য জানি, কিন্তু এই মেলায় এসে চোখের সামনে দেখলাম মাটির কাজ কীভাবে হয়। একজন শিল্পী কীভাবে খালি হাতে হাঁড়ি বা ফুলদানী বানাচ্ছে এটা সত্যিই অবাক করা। আগে বুঝিনি এই কাজ কত পরিশ্রমের।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইশরাত ফারজানা বলেন, কুমার জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে আমরা কুমার পরিবার থেকে ২০ জন করে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। সেই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আধুনিক জিনিসপত্র ও বর্তমানকালে যেসব জিনিসপত্রের চাহিদা রয়েছে হাতের তৈরির সেইসব বিষয়ে তাদেরকে ধারণা প্রদান করা।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে তারা যেসব জিনিসপত্র তৈরি করবে আমরা সেগুলো বাজারজাতকরণে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। যাতে তারা এই সময়ের উপযোগী ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী যদি জিনিসপত্র তৈরি করতে পারে। সেগুলো বাজারজাতকরণের মাধ্যমে তারা যেন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এবং তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে তাদের এই প্রফেসন কাজে লাগবে।