রাত ৪:০৫, ৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বরিশাল প্রতিনিধি
গত ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে শহীদ ভোলার মো. হাসানের (২০) মরদেহ ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে শনাক্ত করে দীর্ঘ ছয় মাস পরে তার নিজ গ্রামে এনে দাফন করা হয়েছে। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের কাচিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে হাজারো মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসানকে চিরবিদায় জানান। পরে একই গ্রামের উত্তর শাহা-মাদার মোহাম্মদীয় জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
এ সময় গণহত্যায় জড়িতদের বিচার ও গণহত্যার দায়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে হাসানকে শহীদি মর্যাদা দেওয়ার দাবিও জানান পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে হাসানের পরিবারের কাছে হাসানের মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে। পরে শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) জুমার নামাজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে শহীদ হাসানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে গণহত্যার বিচারের দাবিত হাসানের মরদেহ নিয়ে কফিন মিছিল করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। পরে শনিবার সকালে ঢাকা থেকে হাসানের মরদেহ ভোলায় তার নিজ গ্রামে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ হাসান ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাচিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর বেপারি বাড়ির ভাড়াটিয়া দিনমজুর মো. মনির ও গোলেনুর বেগম দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান ও তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।
হাসানের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, হাসান নিখোঁজের ৫ মাস পর গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে তার পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে থাকা অজ্ঞাত কয়েকটি মরদেহের মধ্য থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সহায়তায় প্রাথমিকভাবে হাসানের মরদেহ শনাক্ত করেন তার পরিবারের সদস্যরা। পরে ১৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ি থানার মাধ্যমে আদালতের নির্দেশে মালিবাগের সিআইডি অফিসে হাসানের বাবা-মা ডিএনএ নমুনা দেন এবং ১২ ফেব্রুয়ারি হাসানের ডিএনএ নমুনা মেলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরের দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে হাসানের মরদেহ তার পরিবারে কাছে হস্তান্তর করে ঢাকা মেডিকেল কতৃপক্ষ।
শহীদ হাসানের বাবা মো. মনির বলেন, আমি অসুস্থ থাকার কারণে ছেলেকে বেশি পড়াশোনা করাতে পারিনি। সংসারে অভাবের তাড়নায় হাসান ঢাকাতে যায় এবং গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারে একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানে কাজ নেয়। তার উপার্জনের টাকায় আমাদের সংসার চলতো। এখন আমার সংসার চালানোর মতো কেউ কেউ। আমার ছেলে গত ৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিখোঁজ হওয়ার ৬ মাস পরে সমন্বয়কদের সহায়তায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আমার ছেলের মরদেহ খুঁজে পায়। কেন আমার ছেলেকে মারা হলো? যারা আমার ছেলেকে মারছে আমি তাদের কঠোর শান্তি চাই, ফাঁসি চাই।
হাসানের বোনের স্বামী মো. ইসমাইল বলেন, গত ৫ আগস্ট আমি আর হাসান যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে ছিলাম। দেখলাম আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ অহরহ গুলি ছুড়ছে। তখন গুলির কারণে আমি অন্যদিকে চলে যাই। কিন্তু হাসান গন্ডগোলের দিকে চলে যায়। এরপর থেকে হাসানের কোনো খোঁজ পাইনি।
হাসানের চাচা নুরে আলম বলেন, গত ৫ আগস্ট থেকে আমার ভাতিজা হাসান নিখোঁজ ছিল, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোথাও পেলাম পাইনি, বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছি। পরে গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের মর্গে অজ্ঞাত কয়েকটি মরদেহ থাকার খবর পেয়ে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে প্রাথমিকভাবে হাসানের মরদেহ শনাক্ত করেছি। ডিএনএ রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা হাসানের মরদেহ খুঁজে পাই।
হাসানের বড় বোন বলেন, দেশের প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিচার চাই এবং শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদি পরিবারের মর্যাদার দাবি জানাই। আমার ভাইকে মেরে আমাদের পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এদিকে হাসানের মৃত্যুর খবরে হতভম্ব স্থানীয়রাও। শেখ হাসিনার বিচারে দাবি জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউনুস বলেন, হাসানের মৃত্যুর খবর আমরা মেনে নিতে পারছি না। শেখ হাসিনা তার বাহিনী দিয়ে হাসানকে গুলি করে মেরেছে। হাসান তাদের সংসারটি ধরে রেখেছিল। আমরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিচার চাই।
হাসানের জানাজায় তার গ্রামের বাড়িতে এসে জাতীয় নাগরিক কমিটির তেজগাঁও থানার প্রতিনিধি ও ভোলা জেলার সংগঠক শাহাদাত খন্দকার বলেন, হাসান একজন দেশপ্রেমিক ছিল। ২৪ এ যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছে, সেটি ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। এ আন্দোলনে সাধারণ শ্রমিক-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিস্ফোরণের মাধ্যমে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। হাসানের মতো বহু লোক রাস্তায় নেমে এসেছে, সে একজন দেশপ্রেমিক ও ভালো ছেলে ছিল, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। হাসানের মতো বহু মায়ের সন্তানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি এ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিও জানাই।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সহিংসতায় ভোলার শহীদদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে। তাদের বাড়ী ভোলার বিভিন্ন উপজেলায়। ৪৭ জন শহীদের মধ্যে মো. হাসান একজন। শুধু জেলা ভোলায় গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান একজন।