বিকাল ৩:১১, ৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক-দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়ম এবং জাল সনদ ধরা নিয়ে কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। অতীতে ‘মিনিস্ট্রি অডিটের’ নামে ইন্সপেক্টর বা পরিদর্শকরা মোটা খামের (অর্থ) বিনিময়ে জাল সনদ ও অনিয়ম না ধরে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পক্ষে প্রতিবেদন জমা দিতো। সেই খাম (অর্থ) বন্ধ করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে দপ্তরটি। এখন থেকে শিক্ষা পরিদর্শকদের নজরদারি করতে রাষ্ট্রীয় দুটি গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও ডিআইএ-এর একটি টিম পরিদর্শকদেরও নজরদারি করবে।
ডিআইএ সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ৩৭ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ধরার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ডিআইএ-তে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। পরিচালক, যুগ্ম পরিচালক থেকে শুরু করে সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক পর্যন্ত প্রায় সবাইকে সরিয়ে নতুন টিম আনা হয়েছে। তাদের দিয়ে চলতি মাসের শেষের দিকে ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে পাঠানো হবে। পরিদর্শনের গিয়ে যাতে ইন্সপেক্টররা আর্থিক কোনো সুবিধা নিতে না পারে সেজন্য তারা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) নজরদারিতে থাকবেন।
দায়িত্বশীল সূত্রমতে, ডিআাইএ কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে ১৬টি টিম করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিদর্শনের টিম গঠন করা হচ্ছে। টিমগুলো যেসব জেলা বা উপজেলায় যাবেন সেখানের এনএসআই ও ডিজিএফআই-কে অফিসিয়াল চিঠি দেবে ডিআইএ। মাঠে যাওয়ার পর নজরদারি করার জন্য যা করণীয় সেই অনুমতি দুটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দেওয়া হবে। এছাড়া ডিআইএ নিজস্ব একটি মনিটরিং টিম, এলাকা ভিত্তিক নিজস্ব সোসিংয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে পরিচালককে জানাবে। এতে মিনিস্ট্রি অডিটের নামে মোটা খাম নেওয়ার বদনাম থামানো যাবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শনে গিয়ে মোটা খাম নিয়ে আসার রীতি বন্ধ করতে চাই। এজন্য অডিট ও ইন্সপেকশনে কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ফর্ম কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ডিআইএ নিজস্ব পদ্ধতিতে টিমগুলো মনিটরিং করা ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেমের সহযোগিতা নেওয়া হবে। কেউ টাকা দিলে এই শ্রেণির মানুষজন জানবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ডিআইএ এমন উদ্যোগের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া-দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আগে এক বা দুই জায়গা ম্যানেজ করতে হত, এখন আরও অনেককে ম্যানেজ করতে হবে এমন দাবি করে ঘুষের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
সারাদেশে ৩৬ হাজার ৭০০ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ লাখের বেশি শিক্ষক কর্মচারীর রয়েছে। প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগসহ ২০ ধরনের তথ্য যাচাই হয় ডিআই পরিদর্শন ও নিরীক্ষণে। ডিআইএ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা দুই ভাগে হয়ে থাকে। প্রথমভাগে থাকে অডিট বা নিরীক্ষা। এই ভাগে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগে অনিয়ম এবং জাল সনদ শনাক্ত করাসহ অন্তত ২০ ধরনের তথ্য উঠে আসে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও সঠিকতা যাচাই, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার যথার্থতা যাচাই, আর্থিক বিষয়াদি, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত, প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ও স্বীকৃতির শর্ত, সরকারের আদেশ যথাযথভাবে পালন করছে কি-না এসব বিষয়। দ্বিতীয় ভাগে হয় ইন্সপেকশন বা পরির্দশন। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় অ্যাকাডেমিক সুপারভিশন। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা মাফিক পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়া হয়। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান করা। ডিআই্এ কর্মকর্তা মূলত প্রথম ভাগ অডিটের দিকে বেশি মনোযোগী থাকে কারণ এখানে নাড়া দিলেই প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা পাওয়া যাবে এবং পরির্দশনকে ম্যানেজ করতে আগ্রহী হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি মাসের শেষের দিকে সারাদেশে ১৬টি টিমে ভাগ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ট্যুরে আগে ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করে ডিআইএ। সেখানে পরিদর্শনের গিয়ে কী করবেন, কী করবেন না এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। এবার নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে-অডিটের চেয়ে পরিদর্শনের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া। শুধু তাই নয়, যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের সনদ, নিয়োগ প্রক্রিয়া একবার যাচাই হয়েছে সেগুলো পুনরায় যাচাই না করার।
ডিআইএ কর্তাব্যক্তিদের ভাষ্য, অডিটের কাজ করতে গিয়ে পরির্দশক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান বা শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধান চায় নিয়োগ, প্রশাসনিক বা আর্থিক ঝামেলার বিষয় যেন প্রতিবেদনে না আসে। আর সেই সুযোগে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আসেন পরিদর্শকরা। সেজন্য অডিটের পরিবর্তে পরিদর্শনের বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদিও ডিআইএ নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করলেই সব তথ্য চলে আসবে।
তবে কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের কিছুটা মন খারাপ করছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, অ্যাকাডেমিক সুপারভিশন করার জন্য ডিআইএ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই কাজ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি অধিদপ্তর, বিভিন্ন প্রকল্প, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা রয়েছেন। ডিআইএ-৭-৮ বছর পর পর একবার সুপারভিশন করলে আদতে কিছু হবে না। এটা আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অবস্থা।
এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি এমন নয়, আমরা অডিটের চেয়ে অ্যাকাডেমিক সুপারভিশনের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তারা ঠিকমতো ক্লাস হয় কি-না, ক্লাস রুম, টেবিল, বেঞ্চসহ অন্যান্য সরঞ্জামি ঠিক আছে সেগুলো দেখবে। শিক্ষকদের মানের বিষয়টি নজর দেবেন।
বিগত সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতেন পরিদর্শকরা—এমন অভিযোগ সবার মুখে মুখে। বিশেষ করে ডা. দীপু মনি ও নওফেলের সময় এ দপ্তরটি ছিল ছাত্রলীগ নেতাদের পদায়নের আতর ঘর। সম্প্রতি আ.লীগের লিফলেট বিতরণ করে গ্রেপ্তার হওয়া মুকিব মিয়া ৫ আগস্টের আগে ছিলেন এই দপ্তরে। এছাড়া ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে মিছিল করা শিক্ষা ক্যাডারে ৩০ জন কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তাদের বেশিরভাগ ছিল এই দপ্তরের। নতুন সরকার এসে বেশিরভাগকে অন্যত্র বদলি করলেও এখন রয়ে গেছে চারজন।
তারা হলেন, শিক্ষা পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক কামরুন নাহার, শেখ নুরুন্নাহার ও মনিরা মুর্শেদ। এরমধ্যে কামরুন নাহার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। এরপর দীপু মনির হাত ধরে আসে ডিআইএ। স্লোগানের সম্মুখভাগে থাকা কামরুন্নাহার খুঁটির জোর কেউ জানে না। আর মুনিয়া মুর্শেদ ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খানের স্ত্রী। সোহানের পরিচয়ে ওই সময় ডিআইএ পদায়ন নেন এবং সোহান এসে তার স্ত্রী বলে পরিচয়ে করিয়ে যান। যদিও সোহান তার স্বামী না বলে অস্বীকার কর মনিয়া মুর্শেদ বলেন, আপনি যা জানেন তা ভুল। একই দপ্তরে বহাল আছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শেখ কামরুন্নাহারও।
জানা গেছে, গত ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের চকরিয়া পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্র-জনতার মারধরের শিকার হন একজন কর্মকর্তা। তিনি ৪ আগস্টের মিছিলে স্লোগান দিয়েছিলেন এমন অভিযোগে তাকে মারধর করে জনতা। পরে ট্যুর বাতিল করে তিনি দ্রুত ঢাকায় চলে আসেন। একই সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা অন্যান্য টিমকে দ্রুত ঢাকা নিয়ে আসা হয়। এখন এই চারজনকে মাঠে পাঠালে চকরিয়ার ঘটনা পুনরায় ঘটতে পারে এমন ভয় পাচ্ছে কর্তাব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএ পরিচালক বলেন, কাকে বদলি করবে কাকে রাখবে সেটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তবে আগে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি আমাদের মাথায় রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাছে মিনিস্ট্রি অডিট মানে আতঙ্ক। শিক্ষকদের মধ্যে ভয় দেখানো নিয়মিত পরিদর্শনকে ডিআইএ কর্মকর্তারা মিনিস্ট্রি অডিট নাম দেয়। সেই ভয় দেখিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীদের এক মাসের বেতন কখনও দুই মাসের বেতন বা সমপরিমাণ পরিমাণ টাকা নিয়ে আসতেন। সামনে ট্যুরে কোনও কর্মকর্তা মাঠে গিয়ে মিনিস্ট্রি অডিট বলতে পারবে না, এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ৬ মাস হয়ে গেলেও এ দপ্তরটিতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। মাঝখানে পদ দখল নিয়ে পরিচালক, যুগ্ম পরিচালকের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্থবির হয়ে প্রতিষ্ঠানটি। শেষে দুইজন বিএনপিপন্থি শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশে ২ হাজার ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে তা অর্জন করা হয়। চলতি অর্থ বছরের জন্য ২৫০০ ঠিক করা থাকলেও সেটি নিচের দিকে। ফলে অধিদপ্তর ও কর্মকর্তাদের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা (এপিএ) অর্জনের সামনে দিকের থাকা ডিআইএ এবার পিছিয়ে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নভেম্বর মাসে কয়েকটি টিম মাঠে গেলেও কাজ ছাত্র জনতার রোষানলের ভয়ে পরিদর্শন শেষ না করেই চলে আসেন। মোটকথা গত তিন মাস ধরে বন্ধ পরিদর্শন। এতে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক-প্রশাসনিক দুর্নীতি ও নিয়োগে অনিয়ম খতিয়ে দেখা এবং জাল সনদ যাচাইয়ের কাজও হচ্ছে না। কাজ না থাকায় অফিসে এসে চা-নাশতা খাওয়া আর গল্প-আড্ডাতেই সময় কাটাচ্ছেন ৩৫ কর্মকর্তা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে অধিদপ্তরে নতুন পরিচালক পদায়ন করা হয়েছে, ডিআইএ সংস্কারে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু উদ্যোগও। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালক বলছেন, চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পরিদর্শনের কাজ পুরোদমে শুরু হতে পারে।
তিন বছরে ১২০ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত
ডিআইএ ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৬১৫টি সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করেছে। এই তিন অর্থ বছরে মোট ১২০ কোটি ৮৬ লাখ ২৩ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে এই টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরতের সুপারিশ করেছে। এর আগের দুই অর্থবছরে পরিদর্শন করা হয় ৪ হাজার ৩৮০টি প্রতিষ্ঠান। আর জাল সনদ চিহ্নিত করা হয় ২৬৮ জন শিক্ষকের। এই সময়ে ১৩৭ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪৭ টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হয়।