ভোর ৫:১৪, ১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ শাসনের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও একই সুর আসে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয় জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হবে ২৪–এর ‘গণবিপ্লব’।
রাজনৈতিক জাতীয় ঐক্য কী উপায়ে হবে সেটা নিয়ে যখন জোর আলোচনা চলছে, তখন জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য জাতীয় রাজনীতিতে কিছুটা ঘোলাটে পরিবেশ তৈরি করেছে। বিশেষ করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে নতুন করে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৯ ডিসেম্বর রিকশা, ভ্যান ও অটোচালক দলের উদ্যোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার আমলে তাদের দোসর এস আলম ব্যাংক লুট করেছে। আর এখন এস আলমের উত্তরসূরি হয়ে ইসলামী ব্যাংক গ্রাস করে নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। তাহলে কীভাবে বলছেন—এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে মানুষ দেখতে চায় না। কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, সেটা কি আমরা বুঝতে পারি না?”
রিজভী তার বক্তব্যে ৫ আগস্টের পর ইসলামী ব্যাংক দখল, দখলবাজি, টেন্ডারবাজির কথা উল্লেখ করে বলেন, “…রগকাটা পার্টি কারা জনগণ জানে না? কারা পায়ের রগ কাটে জনগণ তাদের চেনে। খুব ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন। আপনাদের ১৯৭১ সালের অর্জন কী? আপনারা ৭১ সালে বিরোধিতা করেছেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন, এই গৌরব বিএনপির। ৯০ সালের গৌরব বিএনপির। সেদিনও আপনারা শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে গিয়েছিলেন। ইসলাম নিয়ে রাজনীতি, মুনাফেকির অভিযোগও তোলেন।
জামায়াতের আমিরের প্রতি ইঙ্গিত করে রিজভী বলেন, ৫ আগস্টের পরে আপনারা বললেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চান। আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনাদের নেতা মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দেওয়ার কারণে সুখরঞ্জনকে শেখ হাসিনার গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছে। এই সুখরঞ্জন যে ন্যায়, নীতির শিক্ষা দিয়েছে, আমি ওই রাজনৈতিক দলকে বলব তার কাছ থেকে শিখুন ন্যায়-নীতি। আর শেখ হাসিনার প্রতিটি গুম-খুনের দোসর হচ্ছে ভারত।
রিজভীর ওই বক্তব্যের পর রাতেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় বিবৃতি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। রিজভীর প্রত্যেকটি জামায়াত বিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ ও প্রতিউত্তর দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ বিবৃতিতে বলেছে, প্রতি অভিযোগ উত্থাপনের আগে রিজভীর আত্ম-পর্যালোচনা করা উচিত। কারা দলীয় টিম নিয়ে ভারত সফর করে, ভারতের সঙ্গে সখ্য করার চেষ্টা করেছেন, তা জনগণ খুব ভালো করেই জানেন।
ইসলামের নামে রাজনীতির নামে জামায়াতে ইসলামী কখনো মোনাফেকি করেনি উল্লেখ করে দলটির পক্ষ থেকে পাল্টা জবাবে বলা হয়েছে, রিজভী অবশ্যই অবগত আছেন ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্ন মতের লোকদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য করা হয়েছিল তা কী জাতির সঙ্গে মোনাফেকি নয়? জনগণ এই রাজনৈতিক ছন্দ পতনের ইতিহাস ভুলে যায়নি। এ ব্যাপারে জামায়াত মনে করে, জাতীয় ঐক্যের আলোচনার মধ্যে এমন বক্তব্য কাঙ্ক্ষিত নয়। রিজভীর বক্তব্যই যে বিএনপির বক্তব্য নয় তা এখন দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত।
তিনি (রিজভী) রগকাটার কথা বলছেন, জামায়াত বা ছাত্রশিবির কি কখনো রগ কেটেছে? এটা তো একটা অপবাদ, এরকম রাজনৈতিক ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে অতীতে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বহুবার মতিউর রহমান আকন্দ, জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঐক্যবিরোধী অপপ্রলাপ শুরু কারা করলো? সেটা আগে দেখতে হবে। তিনি (রিজভী) যা বলেছেন সেটি সঠিক না বেঠিক তা দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয়। যেকোনো ইস্যুতে সেটি যদি সঠিক হয় তাহলে যেকোনো নাগরিকের কথা বলা দায়িত্ব। সত্য বলতে সমস্যা নেই, কিন্তু যদি বেঠিক হয়? রিজভী সাহেব যা বলেছেন তা পুরোপুরি অসত্য।
“তিনি (রিজভী) রগকাটার কথা বলছেন, জামায়াত বা ছাত্রশিবির কি কখনো রগ কেটেছে? এটা তো একটা অপবাদ, এরকম রাজনৈতিক ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে অতীতে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বহুবার।” আকন্দ বলেন, ‘অতীতের এরকম অনেক অপবাদের শিকার জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির। চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। সত্যিকার অর্থে এরকম কোনো অপবাদের সঙ্গে জামায়াত বা শিবিরের বিন্দুমাত্র সংশ্লেষ নাই।’
‘ভারতকে খুশি করার জন্য জামায়াতে ইসলামী ভূমিকা রাখছে’—রিজভীর এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘এ ধরনের একটা প্রমাণ বা নমুনা কেউ দিতে পারবে না যে জামায়াতে ইসলামী ভারতকে খুশি করতে চেষ্টা করেছে। ভারতের কারণেই আমাদের নেতাদের ফাঁসি হয়েছে। এরপরও তো জামায়াত আপস করেনি। বরং উল্টোটাই তো বলা যায়, তারাই তো নির্বাচনের আগে টিম করে ভারতকে খুশি করতে ভারত গেছেন। এটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’
আমরা কখনো বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলিনি। বলার প্রশ্নও ওঠে না। রাজনীতিতে সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধার যে নমুনা তা রিজভী সাহেবই মনে হয় প্রথম ভঙ্গ করলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ মুনাফেকি প্রসঙ্গে জামায়াতের এ মুখপাত্র বলেন, “কিসের মুনাফেকি? জামায়াতে ইসলামী কোনো মুনাফেকি করেনি। ২০১৮ সালে ২০ দলীয় জোট থাকতে তারা আবার ড. কামালের নেতৃত্বাধীন আরেকটি জোটে গেলেন! এটা কি তারা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে কথা বলে করেছিলেন? শরিকদের মতামত নেয়নি বিএনপি। একটা জোটে থাকলে সেই জোটের স্বার্থটা আগে দেখতে হয়। তারা সেটা করেননি। তারা কোন স্বার্থে তবে গিয়েছিলেন? এরমধ্যে তিনি (রিজভী) আরেকটি অবান্তর প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, বলেছেন— ২২টি সিট জামায়াত বাগিয়ে নিয়েছিল। ২০, ৩০ বা ৫০ আসন বড় বিষয় না, একটা জোট থাকতেই আরেকটা জোট কেন? বরং জোটের বৃহৎ শরিক দল হিসেবে তারা শরিকদের মতামত না নিয়ে অন্যদিকে যাওয়ায় মুনাফেকি তো তারাই করেছেন। সুতরাং রিজভী সাহেবের সব বক্তব্যই অযৌক্তিক ও অসত্য।
মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘এরপরও ওনি কেন কি উদ্দেশ্যে এমন বক্তব্য দিলেন, তার ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন। আমরা জামায়াতের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়েছি। আমরা কখনো বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলিনি। বলার প্রশ্নও ওঠে না। রাজনীতিতে সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধার যে নমুনা তা রিজভী সাহেবই মনে হয় প্রথম ভঙ্গ করলেন’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
দলীয় অবস্থান বিএনপিকেই ব্যাখ্যা করতে হবে রিজভীর বক্তব্য কি দলীয় বক্তব্য? তা বিএনপিকেই ব্যাখ্যা করতে হবে বলেও উল্লেখ করে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, রিজভীর বক্তব্য দল হিসেবে বিএনপি কীভাবে দেখতে তা বিএনপিকেই পরিষ্কার করতে হবে বলে জামায়াত মনে করে।
এখনো দেশ স্থিতিশীল হয়নি। এই অবস্থায় এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য। আমি মনে করি, বিরোধী দলীয় ঐক্যটা এখন বেশি জরুর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির কেন রিজভী হঠাৎ এমন বলছেন? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী বলেন, জামায়াতে ইসলামী মনগড়া বা অনুমান নির্ভর কথা বলে না। সঙ্গত আমরা অনুমাননির্ভর কিছু বলতে চাই না। জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আরও বাড়বে। দেশের জনগণ তো বটেই সেটা সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে। সুতরাং এসব রাজনৈতিক কথাবার্তায় জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা কমবে না। বরং রিজভী সাহেবদেরই জনপ্রিয়তা নষ্ট হবে।
তবে জাতীয় ঐক্যই জামায়াত ইসলামীর মনোযোগের কেন্দ্রে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ঢাকা পোস্টকে বলেন, “দেশে এখন ক্রাইসিস দানা বেঁধেছে। এখনো দেশ স্থিতিশীল হয়নি। এই অবস্থায় এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য। যেহেতু বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রধান দুটি বড় দল এখন। আমি মনে করি, বিরোধী দলীয় ঐক্যটা এখন বেশি জরুরি।”
তিনি বলেন, কিন্তু এসময় রিজভী সাহেব কেন এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা তাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমরা একটি বিবৃতি দিয়ে জামায়াতের অবস্থান পরিষ্কার করেছি মাত্র। আমি মনে করি, তারা এধরনের তৎপরতা থেকে সরে আসবেন। বিএনপি জামায়াতসহ অন্যদলগুলো মিলে কীভাবে একটি বৃহৎ ঐক্য গড়া যায় সেদিকে অধিকতর মনোযোগী হওয়া উচিত।
একদলের বিরুদ্ধে আরেক দলের দোষারোপের যে রাজনীতি তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। দোষারোপের অপরাজনীতি থেকে বেরিয়ে দেশের স্বার্থে মৌলিক রাজনীতির জন্য ঐকমত্য ও ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ভারতের সঙ্গে জামায়াত সম্পর্ক উন্নয়নের বক্তব্যকে হাস্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। এটা সবাই জানে। আমাদের ১১ জন নেতাকে ফাঁসি দিয়ে, জেলে আটক থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে জেলে যেতে হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছে।
তাহের বলেন, গত ৫ আগস্ট কেন্দ্রিক যে আন্দোলন হয়েছে সেখানে জামায়াতের অবস্থান ও ভূমিকা ছিল শুরু থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট। আমাদের আত্মত্যাগও অনেক। এরপরও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলাটা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের ওপরে আওয়ামী লীগের অত্যাচারে ভারতের ভূমিকা তো স্পষ্ট ছিল।
জামায়াতের এ শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘আর যারা এখন এসব কথাবার্তা বলছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেন, নির্বাচনের আগে তারা কেন ওই দেশ জিয়ারতে গিয়েছিলেন। যাই হোক এসব ব্যাপারে বেশি কথাবার্তা বলা উচিত হবে না। আমি মনে করি, একদলের বিরুদ্ধে আরেক দলের দোষারোপের যে রাজনীতি তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। দোষারোপের অপরাজনীতি থেকে বেরিয়ে দেশের স্বার্থে মৌলিক রাজনীতির জন্য ঐকমত্য ও ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।