রাত ৪:৪৮, ১২ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:

রবি মৌসুমে সার-বীজের সংকট, খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা কৃষকের

নিজস্ব প্রতিবেদক
আলু, গম ও ভুট্টার ক্ষেত আছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার চাষি ফরিদ উদ্দিনের। কিন্তু চাষের মৌসুমে সার নেই। উৎপাদনে বড় ক্ষতি হবে ভেবে বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনেছেন তিনি। উত্তরের আরেক জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের চাষি কামরুজ্জামান। চাষাবাদে সার সংকট নিয়ে আক্ষেপ করে কামরুজ্জামান বলেন, ‘ইউরিয়া সার পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু দাম বেশি নিচ্ছে। টিএসপি নেই, কোথাও মিললে যেমন খুশি দাম নিচ্ছে। ডিলাররা সংকটের অজুহাতে সরাসরি সার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গেলে তারা অতিরিক্ত দাম হাঁকেন, কৃষকরা জিম্মি হয়ে গেছেন।’

চাষি ফরিদ উদ্দিন ও কামরুজ্জামানের মতো উত্তরাঞ্চলের বহু কৃষক অভিযোগ করেন, সার ও বীজ সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই দেশের উত্তরাঞ্চলে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। এখন দেশের অন্য অঞ্চলেও সংকট দেখা দিচ্ছে। সংকটের কারণে সরকারি সার এখন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বীজ ও সেচের খরচ এখন আকাশচুম্বী। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ ফসল উৎপাদন হওয়া রবি মৌসুমে বোরো ধান, গম, আলু, সরিষাসহ অন্য ফসল চাষের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা কৃষকদের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁ, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় এ সংকট আরও বেশি। ডিলার, সাব-ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেজিপ্রতি ২ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ও মিউরেট অব পটাশসহ (এমওপি) অন্যান্য নন-ইউরিয়া সার বিক্রি হচ্ছে।

কয়েক জেলার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত দামে ইউরিয়া সার ২৭ টাকা কেজি দরে বিক্রির কথা থাকলেও ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া নন-ইউরিয়ার মধ্যে টিএসপি সার মিলছে না। মিললেও দাম নেওয়া হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা পর্যন্ত বেশি।

তারা বলছেন, গত বছর এপ্রিলে একদফা সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপর এখন সেই দামেও সার না পাওয়ায় প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ বাড়ছে বোরোসহ বিভিন্ন রবিশস্য উৎপাদনে। ‘এখন মজুত কম হলেও সার আমদানি প্রক্রিয়া চলমান। আমদানিতে কোনো সমস্যা নেই। ক্রমাগত সার আসবে। সারের কোনো সংকট হবে না।’-বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান

চাহিদার তুলনায় মজুত কম
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সারের মজুতের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, চলতি মৌসুমে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের যে চাহিদা, সে পরিমাণ সার নেই। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নন-ইউরিয়া হিসেবে পরিচিত টিএসপি সারের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত (চার মাস) চাহিদা তিন লাখ ৬১ হাজার টন, যেখানে মজুত আছে এক লাখ দুই হাজার টন। চাহিদার সাত লাখ ৪৪ হাজার টন ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের বিপরীতে মজুত এক লাখ ৩৯ হাজার টন এবং চার লাখ ১৩ হাজার টন এমওপির বিপরীতে মজুত দুই লাখ ২৯ হাজার টন।

অন্যদিকে, ইউরিয়া সার শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়কে জোগান দেয়। এর মধ্যে প্রধান এ সারের মজুতেও টানাটানি শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, বোরো মৌসুমে আগামী চার মাসে ১৪ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন। যেখানে বিসিআইসির হাতে আছে সাত লাখ ২৫ হাজার টন। এর মধ্যে দেড় লাখ টন আমদানি করা, যা পাইপলাইনে রয়েছে। অর্থাৎ দেশে এসে পৌঁছায়নি।

বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার রয়েছে তা চলতি ডিসেম্বর ও আগামী মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে বিসিআইসি এও বলছে, চলতি ডিসেম্বরে দেড় লাখ মেট্রিক টন ছাড়াও আগামী জানুয়ারিতে দুই লাখ ১০ হাজার টন, ফেব্রুয়ারিতে দেড় লাখ টন ও মার্চে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া আমদানির চুক্তি রয়েছে। এসব সার এলে সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরমধ্যে আরও কিছু দেশ থেকে ইউরিয়া আমদানির চেষ্টা চলছে।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এখন মজুত কম হলেও সার আমদানি প্রক্রিয়া চলমান। আমদানিতে কোনো সমস্যা নেই। ক্রমাগত সার আসবে। সারের কোনো সংকট হবে না। ‘এখন চলার মতো সার রয়েছে, তারপরও মজুত কম বলে সংকট তৈরি হচ্ছে। কৃত্রিম সংকটও করছেন অসাধু ডিলার ও ব্যবসায়ীরা। আবার সময় মতো যদি বিদেশ থেকে সার না আসে বড় সংকট হবে, এটা উদ্বেগজনক।’- সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক

দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সরকারের
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রবি মৌসুমে সারের সংকট হলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। কারণ এখন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের মূল সময়। এছাড়া চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় বোরো মৌসুম শুরু হচ্ছে। দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গম ও তারপরের শস্য আলু মাঠে রয়েছে। পেঁয়াজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসলও আছে। এ সময় মজুত সংকটে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে, এটা খুবই দুঃখজনক।

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, এখন চলার মতো সার রয়েছে, তারপরও মজুত কম বলে সংকট তৈরি হচ্ছে। কৃত্রিম সংকটও করছেন অসাধু ডিলার ও ব্যবসায়ীরা। আবার সময় মতো যদি বিদেশ থেকে সার না আসে বড় সংকট হবে, এটা উদ্বেগজনক। এ সময় সারের সংকট হলে উৎপাদনে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যে কারণে সরকারকে দ্রুত গুরুত্ব সহকারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত বছর একদফা সারের দাম বাড়িয়েছিল। ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা এবং এমওপি ২০ টাকা করা হয় ওই সময়।

এরপর গত মৌসুমে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনের খরচ তিন টাকা বেড়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে দেখা যায়, গত বোরোতে (২০২৪ মৌসুম) এক কেজি চাল উৎপাদনের খরচ তিন টাকা বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হয়। ধানের খরচ ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ ধান ও চালে উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বাড়ে ওই সময়।

আর এখন সেই বাড়তি নির্ধারিত দামেও সার মিলছে না। এতে খরচ নিয়ে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা। সংকট আছে বীজেরও দেশে আলু, পাটসহ বিভিন্ন রবি ফসলের বীজের সংকট রয়েছে। অনেক কৃষক আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করে হন্যে হয়ে খুঁজছেন বীজ। এ বছর আলু বীজের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকাও ছাড়িয়েছে অনেক এলাকায়, যা রেকর্ড সর্বোচ্চ।

কৃষকদের অভিযোগ, বেশি দামে বিক্রির জন্য অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের দোকান বা গুদামে বীজ রাখছেন না। কৃষকের সঙ্গে দামে দফারফা হলে অজ্ঞাত স্থান থেকে আসছে বীজ। অন্যদিকে, ডিলাররা এবার বীজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন বলে বিভিন্ন বীজ সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোকে দুষছে।পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এ বছর বীজ সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের বিভিন্ন এলাকার বীজকেন্দ্রে গিয়ে বীজ পাচ্ছেন না কৃষকরা।

হাওরেও সার-বীজের সংকট শুরু
এখন দেশের হাওর এলাকায় আগাম বোরো চাষ শুরু হয়েছে। সেখানে চলছে জমি তৈরি, বীজ ধান বপন, জমিতে সেচ ও সার দেওয়াসহ নানান প্রস্তুতি। ওই এলাকার কৃষকরা জানিয়েছেন, হাওর এলাকার বাজারে বিএডিসির ধান বীজের তীব্র সংকট চলছে। বাধ্য হয়ে তাদের চড়া দামে বেসরকারি কোম্পানির বীজ ধান কিনতে হচ্ছে।