বিকাল ৫:৩১, ১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু, ১২ লাখ টাকায় ধামাচাপা দিলেন দুই চিকিৎসক

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকার একটি বেসরকারি ল্যানসেট হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও অভিযোগ ওঠার পরপরই চিকিৎসকরা রোগীর স্বজনদের ওপর নানা প্রকার চাপ প্রয়োগ করে সমঝোতা করতে বাধ্য করেছেন। এ ঘটনায় মামলা না করার শর্ত দিয়ে রোগীর স্বজনদের ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার ও ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির। উভয়পক্ষের মধ্যে একটি লিখিত আপসনামাও হয়েছে। এতে রোগীর স্বজনদের পক্ষে দুজন এবং দুই চিকিৎসক সই করেছেন। এ ছাড়া সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন আরও দুজন।

উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত আপসনামাটি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। আপসনামায় উল্লেখ করা হয়, ১৬ নভেম্বর বিকেলে পাঁচলাইশ মডেল থানার অধীন ফজলুল কাদের রোডের মুরাদ এসকান্দরের (৪৫) কিডনিতে থাকা পাথর অপসারণে অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে রোগী মৃত্যুবরণ করেন। ল্যানসেট হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যু সনদপত্রে ভিকটিমের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘Sudden Cardiac arrest with Irreversible Cardio Respiratory Failure’ উল্লেখ করেন। এটা একটি নিছক দুর্ঘটনা। তারপরও রোগীর একজন শিশু সন্তান থাকায় এবং ভিকটিমের স্ত্রী খাদিজা বেগম সাকি কম বয়স্ক হওয়ায় তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানবিক কারণে উভয়পক্ষ একটি সমঝোতা করেন। সমঝোতা অনুযায়ী চিকিৎসকরা ভুক্তভোগীর সন্তান ও স্ত্রীকে ১২ লাখ টাকা প্রদান করবেন। এর মধ্যে ৬ লাখ টাকা ভুক্তভোগীর সন্তান মিরাজ মাশরাত এবং অবশিষ্ট ৬ লাখ টাকা ভুক্তভোগীর স্ত্রী খাদিজা বেগম সাকি পাবেন। এ ঘটনার বিষয়ে পরবর্তীতে কোনো পক্ষের আর কোনো আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। উভয়পক্ষ ভুক্তভোগী রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে থানায় কিংবা আদালতে কোনো প্রকার মামলা করতে পারবে না।

আপসনামায় রোগী পক্ষে ছয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান ও আজিজুর রহমান নামে দুজন আপসনামায় সই করেন। চিকিৎসকদের পক্ষে অভিযুক্ত দুই চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা হয় এবং সাক্ষী হিসেবে চুক্তিতে ডা. মিনহাজুর রহমান চৌধুরী এবং মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন নামে দুজন সই করেন।

রোগী পক্ষ যদি অভিযোগ না করে আমাদের আসলে ব্যবস্থা নিতে কষ্ট হয়ে যায়। যদি রোগী পক্ষ অভিযোগ দেন আমরা তদন্ত করে দেখব এখানে চিকিৎসকদের আসলে কোনো গাফিলতি ছিল কি না,চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী এদিকে, ছোট একটি অপারেশনে চিকিৎসকের ভুলের কারণে একজনের প্রাণহানি এবং এ ঘটনা টাকার বিনিময়ে রফাদফা করা নিয়ে আলোচনা চলছে চট্টগ্রামের চিকিৎসক মহলে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে দুজন চিকিৎসক এ অপারেশন করিয়েছেন তাদের চিকিৎসা নিয়ে আগে থেকেই নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে। এ কারণে দুই চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করে রোগীর স্বজনদের দ্রুত মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন আইনজীবীরা। না হয় এ ধরনের ভুল চিকিৎসা বাড়তে থাকবে বলে মত তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুক্তভোগী রোগীর কিডনি থেকে পাথর বের করতে মূল অপারেশন করেন ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার এবং অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে চিকিৎসা করেন ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির। তারা ছাত্রজীবনে সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন চমেক হাসপাতাল শাখার সহ-সভাপতি।

চিকিৎসকদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করে জানান, গত ১৫ বছর ধরে এ দুই চিকিৎসক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে নানা তদবির ও টেন্ডারবাজি করেছেন। চিকিৎসার চেয়ে সেসবকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। চিকিৎসক সমাজে দুজনের সম্পর্কে নানা দুর্নাম রয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা রাজনীতি ছেড়ে পুনরায় চিকিৎসা সেবায় মনোনিবেশ করেন।

অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার ও ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির
স্থানীয়রা জানান, ভুক্তভোগী রোগী মুরাদ এসকান্দর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তিনি নগরের বাকলিয়া থানা এলাকায় থাকতেন। আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না মুরাদের। নগরের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর পিলখানা এলাকার মো. মিজানুর রহমানের মেয়ে খাদিজা বেগম সাকিকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসারে মিরাজ মাশরাত নামে ৪ বছর ১০ মাস বয়সী এক ছেলে রয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর কিডনি থেকে পাথর অপসারণের জন্য ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদারের শরণাপন্ন হন মুরাদ। ওইদিনই তার মৃত্যু হয়।

ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী মুরাদ এসকান্দরের শ্বশুর মিজানুর রহমান বলেন, ডাক্তারদের পুরোটাই অবহেলা ছিল। যেখানে অপারেশন করানো হয়েছিল সেখানে আইসিইউ নেই, অপারেশন থিয়েটারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। শুনেছি সেখানে শুধু সিজার করা হয়। চিকিৎসকরা জেনেশুনে ওইখানে অপারেশন করিয়েছেন। ডাক্তাররা আমার মেয়ে জামাইটাকে অকালে মেরে ফেলেছে।

মামলা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ডাক্তারদের সমিতি আছে, তারা পয়সাওয়ালা। আমরা কিছু একটা করলে ডাক্তাররা উল্টো কিছু করতে পারে। এ কারণে আর মামলা করা হয়নি। তবে মেয়েরা কিছু খরচ পেয়েছে।

রোগীর আরেক স্বজন মো. জাবেদ হোসেন বলেন, আমরা চিকিৎসকদের বলেছি উনি ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। এরপর আমরা যাতে মামলা-মোকদ্দমা না করি সেজন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে একটা আপসনামা হয়েছে।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যদি মামলা করি, বাদী যিনি হবেন তারা ভালোভাবে খেতে পারছেন না। তাহলে তারা মামলা চালাবে কীভাবে? অভিযুক্ত ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, তাদেরকে (রোগীর স্বজন) আমরা ম্যানেজ করেছি। সমাধান হয়ে গেছে। এটা নিয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।

আমরা চিকিৎসকদের বলেছি উনি ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। এরপর আমরা যাতে মামলা-মোকদ্দমা না করি সেজন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে একটা আপসনামা হয়েছে
রোগীর স্বজন মো. জাবেদ হোসেনজানতে চাইলে অভিযুক্ত আরেক চিকিৎসক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির বলেন, ঘটনার পরপরই ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে রোগী পক্ষের একশর বেশি লোক হাসপাতাল এলাকায় চলে আসে। পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কিন্তু ৮-১০ জন পুলিশের পক্ষে ওই মুহূর্তে এত লোক সামাল দেওয়া কঠিন। আমরা মব জাস্টিসের আশঙ্কা করছিলাম। সাধারণত এখন রোগী পক্ষ রোগী মারা গেলে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলে। কিন্তু কোনো চিকিৎসকই মেরে ফেলার জন্য রোগীকে অপারেশন করেন না।

তিনি আরও বলেন, ওইদিন সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা অনেকটা বাধ্য হয়েছিলাম। রোগী পক্ষকে আমরা ওই রাতেই ১২ লাখ টাকার চেক দিই। পরের দিন ১২ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে উনারা চেক ফেরত দেন। বিষয়টি থানা পুলিশও অবহিত রয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে জানানো হলে চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, রোগী পক্ষ যদি অভিযোগ না করে আমাদের আসলে ব্যবস্থা নিতে কষ্ট হয়ে যায়। যদি রোগী পক্ষ অভিযোগ দেন আমরা তদন্ত করে দেখব এখানে চিকিৎসকদের আসলে কোনো গাফিলতি ছিল কি না। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম রয়েছে, তারা যাচাই-বাছাই করবেন। এরপর তাদের মতামত সাপেক্ষে অর্থাৎ ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলায়মান বলেন, আমি যতটুকু জানি উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে আপস হয়েছে। উভয়পক্ষ এখানে এসেছিলেন। আমি রোগী পক্ষকে বলেছি যে, আপনারা অভিযোগ দিলে আমি মামলা নেব। আমি তো আর জোর করে নিজে থেকে মামলা নিতে পারি না। তখন রোগী পক্ষ আমাকে বলেছে, যে মারা গেছে মামলা করলে আমরা কী আর তার জীবন ফেরত পাব? বাচ্চাদের জন্য ওরা যে টাকাটা দিয়েছেন, এতেই আমরা খুশি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল গালিব বলেন, এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমটা হচ্ছে, চিকিৎসক আগে থেকে পরিকল্পনা করে ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন, তবে সেটি হবে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেটি দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় উল্লেখ রয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অপারেশন করাতে গিয়ে যদি চিকিৎসকরা অবহেলা করেন অথবা যথাযথ পন্থায় চিকিৎসা না করেন, যে কারণে রোগী মারা গেছেন, সেটি দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড। তিনি আরও বলেন, রোগী পক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী যে কারণেই ওই রোগী মারা যান না কেন, এখানে ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। এক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের উচিত কোনো ধরনের সমঝোতায় না গিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

এই আইনজীবী বলেন, মামলা করতে গেলে আরেকটা বিষয় সামনে আসতে পারে, রোগী পক্ষ গরিব। এক্ষেত্রে আসলে থানায় মামলা করা দরকার। কারণ ফৌজদারি অপরাধে যেসব মামলা থানায় হয় সেসব মামলা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। সরকার আদালতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইনজীবী নিয়োগ করেছেন থানায় হওয়া এ ধরনের মামলাগুলো পরিচালনার জন্য। এখানে চিকিৎসকদের চাপে হোক অথবা অন্য কোনো কারণে হোক সমঝোতা করাটা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। এভাবে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাবেন, আর ডাক্তাররা টাকার বিনিময়ে ছাড় পাবেন, এরকম হলে তো সামনে আমাদেরও ভুক্তভোগী হতে হবে।