সকাল ৬:০৩, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
 
								
রাজবাড়ী প্রতিনিধি : ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে না নিয়ে নিজের হুইল চেয়ারকে রোজগারের মাধ্যম বানিয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী শাওন শেখ। রাজবাড়ী জেলা শহরের শহীদ স্মৃতি স্টেডিয়াম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে প্রতিদিন সকালেই নিজের হুইল চেয়ারের ওপর খুলে বসেন তার ছোট্ট দোকান। সেই দোকানের আয় দিয়ে দিন শেষে মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ভাইয়ের জন্য খাবার কিনে ঘরে ফেরেন শাওন।
শাওন শেখ রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের মাটিপাড়া গ্রামের ভূমিহীন বাসিন্দা রিকশাচালক শাফিক শেখ ও সাহানা বেগম দম্পতির মেজ ছেলে। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী।
জানা গেছে, রাজবাড়ী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের জেলখানার পাশে ভাড়া বাড়িতে থাকেন ভূমিহীন বাসিন্দা রিকশাচালক শাফিক শেখ ও সাহানা বেগম দম্পতি। এই দম্পতির বড় ছেলে সাগর শেখ ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন, মেজ ছেলে শাওন শারীরিক প্রতিবন্ধী ও ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। শাওন পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। পড়তেন রাজবাড়ী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অসুস্থতার মধ্যেও দিয়েছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষা। ভাগ্য সহায় হয়নি শাওনের। ২০২১ সালে অজানা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলে তার। সেখান থেকে কোনো রোগ ধরতে পারেনি চিকিৎসকরা। পরে আর সুস্থ হয়নি শাওন, অচল হয়ে পড়ে তার পা, এরপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তার হাঁটাচলা।
পরে ২০২৪ সালে শাওনের ভাগ্যে জোটে একটি হুইল চেয়ার। ঘরে অলস বসে না থেকে সেই চেয়ারে বিশেষ কায়দায় তৈরি করেন একটি দোকান। জামানো ২ হাজার টাকা দিয়ে দোকানে চিপস, চানাচুর, আচারসহ বিভিন্ন খাবার কিনে শুরু করেন ছোট্ট দোকান। প্রতিদিন সকাল ৯টায় শহরের শহীদ স্মৃতি স্কুলের সামনে হুইল চেয়ার করে তার দোকান নিয়ে বসে শাওন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে বিভিন্ন খাবার কেনে। দোকানে যতটুক লাভ হয় তাই তুলে দেন মায়ের হাতে। মা সাহানা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হার্টে সমস্যা ও মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় নিয়ে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ভুগছেন তিনি। উপার্জিত টাকা থেকে মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় করেন শাওন।
শাওন শেখ বলেন, ২০২১ সলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এক অজানা রোগ বাসা বাঁধে আমার শরীরে। তারপর থেকে আমার হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি। দীর্ঘদিন ঘরে পড়েছিলাম। পরে একসময় চিন্তা করলাম এভাবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না, আরও অসুস্থ হয়ে যাব। তখন নিজের জমানো ২ হাজার টাকা দিয়ে কিছু খাবার সামগ্রী কিনে হুইল চেয়ারে করে শহীদ স্মৃতি স্কুলের সামনে বিক্রি করা শুরু করি। প্রতিদিন বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে মায়ের জন্য ওুষধ কিনি, আমার ও ছোট ভাইয়ের জন্য খাবার কিনি।
সরকারের কাছে ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে আবেদন জানিয়ে শাওন বলেন, আমার বেশি কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। ঠিকমতো যেন চিকিৎসাটা নিতে পারি এবং আমার এই ছোট্ট দোকানটা আরেকটু বড় করতে পারি এজন্য আমি সাহায্য সহযোগিতা চাই।
শাওন শেখের মা শাহানা বেগম বলেন, আমিও এক সময় মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। বর্তমানে অসুস্থতার জন্য আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ওর বাবা একা পরিবার সামাল দিতে হিমশিম খায়। আমি মা হয়ে প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে ওষুধ আনতে বলি। ও কোনোদিন না করে না। ওর একটি বড় দোকান করার ইচ্ছে।
প্রতিবন্ধী সাগরের বাবা মো. শফিক শেখ বলেন, আমি দারিদ্র মানুষ। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। বছর তিনেক আগে অজানা রোগে আক্রান্ত হয় শাওন। পরে ওকে ফরিদপুর হাসাপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কোনো রোগ ধরতে পারেনি তারা। তখন তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল চিকিৎসক। অর্থের অভাবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ছেলের চিকিৎসাটাও আর চালিয়ে যেতে পারিনি আমি। সরকারের কাছে একটাই দাবি আমার এই অসুস্থ ছেলের দিকে একটু নজর দিক।
স্থানীয়রা বলেন, শাওন অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষ। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। দীর্ঘদিন ধরে দেখছি সে কারোর কাছে সাহায্য চায় না, ভিক্ষাও করে না। সে ব্যবসা করে খাচ্ছে। সে যেন ব্যবসা করে খেতে পারে এজন্য সবার সহযোগিতা দরকার।
স্থানীয় শহীদ স্মৃতি স্টেডিয়াম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনয় কুমার বিশ্বাস বলেন, শাওন আমাদের বিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট দোকান করেন। আমরা মানবিক কারণে তাকে ব্যবসা করতে দেই। শাওন সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
রাজবাড়ী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, শাওন শেখ একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলাম সে দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে না। সে যদি সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা অফিসে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে আমরা অবশ্যই তাকে সার্বিক সহযোগিতা করবো এবং খতিয়ে দেখব তার ভাতাটি কেন বন্ধ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু শাওন শেখ স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি হুইল চেয়ারে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেছেন। উনি যদি আমাদের প্রতিবন্ধী ঋণ কর্মসূচি থেকে ঋণ নিতে চান তাহলে আমরা তাকে ঋণ দিয়েও সহায়তা করবো এবং তার আয় বর্ধকমূলক কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করব। প্রতিবন্ধকতার বেড়া পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই করা শাওন প্রমাণ করেছেন সাহস আর দৃঢ় সংকল্প থাকলে কোনো বাধাই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।