রাত ১:১৯, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি : মুন্সীগঞ্জে এ মৌসুমে প্রায় ৩ কোটি টাকার শীতকালীন সবজির চারা বিক্রি হয়ে থাকে। তবে এ বছর সেই লক্ষ্য পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃষ্টি। কৃষকরা যে জমিতে এবার চারা আবাদ করছেন, সেই জমিতে আগেও চারা আবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু এক মাস আগে ভারি বৃষ্টিপাতে সেই সময়ের চারাগুলোর কাঙ্ক্ষিত ফলন না হওয়ায় চারা চাষিরা লোকসানে পড়েন। পরে একই জমিতে আবার চারা চাষ করে লাভের আশায় থাকলেও সাম্প্রতিক বৃষ্টির পূর্বাভাসে সেই আশা এখন শঙ্কায় পরিণত হয়েছে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) বিকেল থেকেই মুন্সীগঞ্জের আকাশ ছিল গাঢ় মেঘে ঢাকা। সন্ধ্যার পর আকাশে হালকা মেঘ ও বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। ফলে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত উদ্বিগ্ন কৃষকদের চারাগাছ বাঁশের ছাটা দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখা গেছে।
এ মৌসুমে মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় শতাধিক কৃষক সবজি চারা উৎপাদনে যুক্ত আছেন। সদরের রামপাল, পঞ্চসার, মহাকালী, বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন এবং টঙ্গিবাড়ীর বেতকা, রায়পাড়া, আবদুল্লাহপুর, সোনারং, ধামারণ, আলদী, কাঠাদিয়া, আব্দুল্লাপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে কৃষকরা ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, টমেটো, ব্রোকলি, কুমড়া, বেগুনসহ নানা সবজির চারা উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও কৃষকরা মুন্সীগঞ্জে এসে চারা কিনে নিচ্ছেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর এখানকার সবজি চারা কেরানীগঞ্জ, সাভার, মানিকগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারদের কাছে বিক্রি হয়।
সদর ও টঙ্গিবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, কৃষকরা সারাদিন বীজতলার পরিচর্যায় ব্যস্ত। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষায় তারা বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের মাচায় বীজতলা ঢেকে রাখছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাচা দিয়ে ঢেকে রাখেন, সকালে রোদ উঠলে তা সরিয়ে দেন। দুপুরে রোদ বেশি হলে আবার ঢেকে দেন, আর বৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গে বীজতলা ঢেকে ফেলেন। পাশাপাশি দুয়েক দিন পরপর পানি ও ওষুধ স্প্রে করেন। কৃষকরা জানান, সবজি চারা উৎপাদনের লক্ষ্যে তারা প্রতি বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে বীজতলা প্রস্তুত করেন, যা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। বীজ বোনার ২৫ দিনের মধ্যে চারা বিক্রি করা হয়। একেকটি বীজতলা থেকে দুই থেকে তিনবার পর্যন্ত চারা উৎপাদন সম্ভব। প্রতি মৌসুমে জেলায় প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি সবজি চারা উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য তিন থেকে চার কোটি টাকা। সবজির প্রকারভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হয় এক হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়।
তবে এবার চারা ব্যবসায়ও পড়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব। চারা উৎপাদনে ব্যবহৃত অধিকাংশ বীজ আমদানি করা হয় জাপান থেকে। এক কেজি কপি বীজের দাম পড়ছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত, আর সবচেয়ে কম দামের ফুলকপি বীজও ৫০ হাজার টাকা কেজি। কৃষকরা জানান, সিন্ডিকেটের কারণে এ বছর প্রতি কেজি বীজে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে। পাশাপাশি সার, শ্রমিক, এবং বাঁশের ছাউনি- সব কিছুর দামই বেড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লাভের আশা ছিল, কিন্তু আবহাওয়ার অনিশ্চয়তায় এখন তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
সদর উপজেলার বানিক্যপাড়া এলাকার কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, এখন জমিতে জাপানের ৭৭৭ জাতের ফুলকপির বীজ বপন করেছি। প্রতি কেজি বীজ ৬৮ হাজার টাকায় কিনেছি। আগে ঢাকার সিদ্দিক বাজার থেকে বীজ আনতাম, এখন ধলাগাঁও বাজারেও পাওয়া যায়। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে সব জায়গাতেই দাম বেশি। আগেরবার বৃষ্টিতে লোকসান হয়েছে, এবার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা ছিল। কিন্তু শুনছি ঘূর্ণিঝড় আসছে- যদি হয়, তাহলে সব শেষ।
কৃষক পারভেজ বলেন, এক মাস আগে বৃষ্টিতে চারা নষ্ট হয়েছে। এবার আবার চাষ করেছি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিন্তু আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, পুরো চালানই নষ্ট হবে।
ভট্টাচার্যেরবাগ এলাকার চাষি বাবু বলেন, এবার বীজের দাম অনেক বেশি ছিল, সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। আগের বৃষ্টিতে লাগানো দানাগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। আবার যদি ভারি বৃষ্টি বা ঝড় হয়, সব শেষ হয়ে যাবে।
শ্রমিক আবু সাঈদ বলেন, আমরা মাঠে কাজ করি। জমির মালিক মাসে ৩২ হাজার টাকা দেন। চারা চাষে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। বৃষ্টি বা রোদ হলে চারাগুলো চাটাই দিয়ে ঢাকতে হয়, পানি দিতে হয়- ছোট শিশুর মতো যত্ন নিতে হয়।
ভট্টাচার্যেরবাগের কৃষক বৃদ্ধ নিজাম শিকদার বলেন, আগেরবার এই জমিতে চারা লাগিয়ে লাভ হয়নি। তখন ৭৭৭ জাতের কপি চাষ করেছিলাম। এবার সবুজ ব্রোকলি জাত লাগিয়েছি। আবহাওয়া ভালো থাকলে লাভ হবে আশা করি।
একই ইউনিয়নের বানিক্যপাড়া গ্রামের কৃষক সোবহান মিয়া বলেন, ২৫ বছর ধরে চারা চাষ করছি। আমাদের এলাকার চারা খুব মানসম্মত, তাই দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকেরা এখান থেকে চারা নেয়। আগে কখনও লোকসান হয়নি, কিন্তু এবার দুর্যোগের কারণে লাভ হবে কিনা বলা যাচ্ছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ৪ হাজার ৯০৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ মেট্রিক টন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বৃষ্টিতে যাতে বীজতলার ক্ষতি না হয়, এজন্য কৃষকদের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। আমি নিজে এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সব সময় কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস ছিল, তেমন বৃষ্টিপাত হবে না বলে আশা করছি। তবুও আমরা সার্বক্ষণিক কৃষকদের পাশে আছি এবং তাদের জন্য দোয়া করছি।
তিনি আরও বলেন, মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা খুবই সচেতন। তারা প্রতিকূল আবহাওয়ায় চারাগুলো চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখে। এসব চারা মানসম্মত এবং এখানকার উৎপাদিত চারা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের ২৫টি জেলায় বিক্রি হচ্ছে।