সকাল ৭:২৮, ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:

খাবারের জন্য হাহাকার, নিদারুণ কষ্টে বানভাসিরা

সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকায় খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এই সঙ্কট চরমে উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। অধিকাংশ ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চলছে।

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গত পাঁচদিন ধরে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এতে সারাদেশের সঙ্গে এই দুই জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ। যদিও গত রবিবার থেকে সিলেটে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। বন্যার পানি প্রবেশ করায় বন্ধ করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ। একদিন পর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। বন্যা কবলিত মানুষদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী।

ঘর-বাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট সুনামগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। তবে কিছু কেন্দ্রে জায়গা সল্পতার কারণে পানিবন্দি মানুষের ঠাঁই মিলছে না। শিশু ও বৃদ্ধদের দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের সংকট। চলছে ত্রাণের জন্য আহাজারি। এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজে ছুঁটছেন। সেনাবাহিনী উদ্ধার কার্যক্রমের পাশপশি ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।

সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী সিলেট সিটি করপোরেশন, ৫টি পৌরসভা ও ১৩টি উপজেলায় মোট ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ৩১ হাজার গবাদিপশুকেও উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সিলেটের প্রায় ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেওয়া ত্রাণ অপ্রতুল বলছেন বন্যাদুর্গতরা। খাদ্য সংকটে অভুক্ত রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা ৩১ হাজার গৃহপালিত পশুও।

সিলেটের সব আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া বানভাসি মানুষেরা ভুগছেন খাবারের তীব্র সংকটে। নগরে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। নগরের বাইরে সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

নগরীর ঘাসিটুলা এলাকায় ইউসেপ ঘাসিটুলা টেকনিকেল স্কুল আশ্রয় কেন্দ্রে দুই শতাধিক মানুষ আছেন। জায়গা স্বল্পতার কারণে অনেকে গাদাগাদি করে আছেন। এই কেন্দ্রের ইয়াসমিন বেগম জানান, বন্যার কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় তারা বের হতে পারছেন না। ত্রাণ কার্যক্রমও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রান্না করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থাও নেই। আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় কাউন্সিলর খাবার দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। খাবারের জন্য মানুষ হাহাকার করছে।

তিনি আরও বলেন, গত চারদিন থেকে মানুষজন খেয়ে না খেয়েই জীবন রক্ষা করছে। শিশুরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। কোনোভাবেই খাবার জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষ ত্রাণের আশায় পথ চেয়ে থাকলেও সরকারি উদ্যোগে তেমন কোনো ত্রাণ এখনও পৌঁছায়নি। নগরের মঈনুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া রুহেল আহমদ বলেন, আজকে কিছু খাবার দিয়ে গেছেন কয়েকজন লোক। এর আগে দুদিন খুব কষ্টে ছিলাম। পানি ও বৃষ্টির কারণে বাইরে গিয়ে খাবার আনারও সুযোগ ছিল না। গত রাতে কেবল মুড়ি খেয়ে ছিলাম।

দুর্গকুমার পাঠশালায় আশ্রয় নেওয়া ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া গত শুক্রবার এ আশ্রয়কেন্দ্র ওঠেন। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার কিছু লোক এসে রান্না করা খাবার দিয়ে যান। এরপর আর কোনো সহায়তা পাননি লিটন। এক দিন কেবল খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। এখানে রান্নার সুযোগ নেই। তাই খুব কষ্টে আছি। তবু তো উপোস থাকা যায় না। আমরা না হয় যেকোনো কিছু খেয়ে ফেললাম, বাচ্চারা তো বুঝতে চায় না। তাই পানি ডিঙিয়ে বাসায় গিয়ে রান্না করে এখানে খাবার নিয়ে আসি।

একই এলাকার মোহাম্মদ আলীও উঠেছেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে। তিনিও জানালেন তিন দিনে কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি। ব্যক্তি-উদ্যোগে কয়েকজন রান্না করা খাবার দিয়েছেন। আলী বলেন, রান্না করা খাবার তো রাখা যায় না। একবেলায় খেয়ে ফেলতে হয়। তাই একবেলা খেলে পরের বেলা উপোস থাকতে হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি বলে জানান সিলেট সদর উপজেলার মানসিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া শরিফা বেগম। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে হাঁড়ি-পাতিল কিছুই আনতে পারিনি। খাবারও আনিনি। এখানে এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ নিয়েও আসিনি। তাই খুব কষ্টে আছি। আশপাশের বাসিন্দারা মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসেন।

গত বুধবার বন্যা পরিস্থিতি অবনতির পর সোমবার পর্যন্ত মহানগরসহ ১৩টি উপজেলায় প্রায় হাজার মেট্রিক টন জিআর চাল, ৪০ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চারটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৪০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। সেনাবাহিনীর ১৩টি ইউনিট ৬০টি বোট দিয়ে বন্যাতর্দের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসাসেবা, খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আবদুল আলিম শাহ বলেন, মহানগরের মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন ৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন ৮০ হাজারের মতো মানুষ আছেন। এখন আর নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্র খোলার মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সিটি করপোরেশনের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা রাতদিন বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

সিলেট জেলা প্রশাসনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার এহসানুল আলম বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই মুহূর্তে জিআরের কোনো চাল মজুত নেই। শুকনো খাবার ও ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতে আছে। আরও ত্রাণ আসছে। সরকার বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে রয়েছে। বন্যা আক্রান্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।

সুনামগঞ্জেও বানভাসি মানুষেরা বাঁচার জন্য লড়াই করছেন। এই জেলার ২৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এখনো সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এ জেলা। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট। কেউ আধাপেট খেয়ে আছেন, কেউবা না খেয়ে। বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। পাওয়া যাচ্ছে না মোবাইলের নেটওয়ার্ক।

তবে এ জেলার বিভিন্ন উপজেলার সড়ক ও বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে থাকলেও শহর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। অনেকে আবার আশ্রয়কেন্দ্র গিয়েও ঠাঁই পাচ্ছেন না। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণসামগ্রী অপ্রতুল। চলছে ত্রাণের জন্য আহাজারি। প্রশাসনও সব জায়গায় পৌঁছতে পারছে না। সার্কিট হাউস থেকে শহরের কিছু মানুষকে রান্না করা খাদ্য বিতরণ করছে প্রশাসন। তবে তা অপ্রতুল।