রাত ১০:১০, ২০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
‘দেশের সবকিছু সচল, শুধু শিক্ষাব্যবস্থা অচল’- অধিকাংশ মানুষ এখন এমনটাই ভাবছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়সীমা বারবার বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন পুরো জাতি। শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেকটা অনিশ্চয়তার পথে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়া এবং দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে আংশিকভাবে কঠোর লকডাউন কার্যকর থাকায়, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় ছুটি বেড়েছে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে লম্বা ছুটির কবলে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত ২০ বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়সীমা বাড়ল। বারবার বন্ধের এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থী-অভিভাবক আগামী দিনগুলো নিয়ে হতাশায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বর্তমান অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিস্থিতি হয়নি। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দ্বীপু মনি বলেছেন, পরীক্ষা না হলে এমন কোনো বিরাট ক্ষতি হবে না। শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত যে আরও প্রলম্বিত হবে তারই ইঙ্গিত।
করোনার প্রভাবে লম্বা সময় ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থমকে আছে। বিশেষ করে, মফস্ব^ল অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক। করোনা নড়বড়ে করে দিয়েছে শিক্ষার ভিতকে। কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেউ জানে না। রাস্তায় যানবাহন চলছে, নদীতে লঞ্চ-স্টিমার সচল। ক্রেতারা নিয়মিত শপিংমলে যাচ্ছে। বিলাসবহুল শপিংমলের ফুড কোডগুলো ভোজনরসিক মানুষের ভিড়ে গমগম। পথেঘাটে পা রাখার জায়গা নেই। হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো তোয়াক্কা নেই। কলকারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক। রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ জনাকীর্ণ। নির্বাচনী প্রচারণায় মানুষের ওপর মানুষ। বলা যায় দেশের সবকিছুই স্বাভাবিক। কেবল স্বাভাবিক নয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
এই দৃশ্যত স্বাভাবিক অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে শিক্ষার্থীরা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। এর প্রভাবও কম নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা আউটডোর গেম থেকে এখন আসক্ত হচ্ছে ইনডোর গেমে। স্মার্টফোন নামক যন্ত্রের পিছনে ঘুরে অল্প বয়সে হারাচ্ছে নৈতিকতা। বাড়ছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ। শিশু গ্যাং নিয়েও আতঙ্কে অভিভাবকরা।
দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়। মাঝে সরকার শিক্ষাব্যবস্থা সচল করার কিছু উদ্যোগ নিলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরের গোড়ার দিকে করোনা সংক্রমণের ৫ শতাংশের নিচে নেমেছিল। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আশার আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মার্চের শেষ দিক থেকে আবার বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এখন সরকার ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে।
বর্তমানে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আক্রান্তের হার গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি। দেশের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া যেসব শিক্ষকের বয়স ৪০ বছরের কম তাদের টিকা কার্যক্রম এখনো শুরুই করা যায়নি। আবার যারা টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন টিকাস্বল্পতার কারণে তাদের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ অনিশ্চিত ছিল। যদিও টিকা এসেছে। টিকা কার্যক্রম বিঘ্ন হওয়ায় সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে সময়মতো টিকা দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সচল করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা নিয়ে এমন সংকটে কোনোদিন পড়েনি।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, মিছিল করছে ক্লাসে ফেরার দাবিতে। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত। তাদের বয়স বাড়ছে। চাকরিতে আবেদন সময় পার হচ্ছে অনেকের। দেশে দিন দিন কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে। দেশের উচ্চবিত্ত ও হোমরা-চোমরা গোছের অধিকাংশ মানুষের সন্তানেরা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে না বললেই চলে। তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সাধারণের ভবিষ্যৎ কী?
যেসব শিক্ষার্থী টিউশনি করে বা খণ্ডকালীন চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করত বা তাদের পরিবার আর্থিক সহায়তা করত, করোনা তাদের সে পথও রুদ্ধ করে দিয়েছে। মূলত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থায় পুরোটাই অচল। প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, অভিভাকদের অসচেতনতা, প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের অনীহা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। সরকার গ্রামীণ জনপদে শিক্ষাব্যবস্থাকেও সচল রাখার চেষ্টা করেছে, তবে সেটা সফল হয়নি প্রযুক্তির অপ্রতুলতা ও অভিভাবকদের আর্থিক অসংগতির কারণে।
১৫ মাস ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একবার এইচএসসি ক্ষেত্রে অটোপাস দেওয়া হয়েছে। এবারও আটকে আছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। ফেব্রুয়ারির এসএসসি এখনো ফরম পূরণ শেষ হয়নি। একবার ফরম পূরণ শুরু হলেও অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ রয়েছে। কোথাও কোথাও আবার শেষ হয়েছে। একবার অটোপাস হওয়াতে পরীক্ষা ও পড়ালেখার প্রতি একধরনের অনীহা দেখা অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে। শিক্ষাব্যবস্থা সচল করা না গেলে আবারও সরকারকে অটোপাসের দিকেই হাঁটতে হবে। এভাবে অটোপাস হলে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। সুতরাং শিক্ষাকে সচল করার বিকল্প নেই।
দেশের বেসরকারি স্কুলগুলো (বিশেষ করে কেজি স্কুল) ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। স্টাফদের বেতনভাতা বন্ধ। ঘরভাড়া দিতে না পারায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ পড়ছে। যেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ঘুরে দাঁড়ানোটা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনার্স-মাস্টার্স পরীক্ষাও আটকে আছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে সেশনজট। কোনো কোনো পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা শুরু হলেও মাঝপথে আটকে আছে বাকিগুলো। আমরা গণমাধ্যমে দেখছি, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা চালুর দাবিতে আন্দোলন করছে।
দেশের বিভিন্ন স্তরের অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বের প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনা মহামারির কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছে। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব ও লকডাউনের কারণে প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, অপুষ্টি, পরিবারের আয় কমে যাওয়া বা বন্ধ হওয়া, স্থূলতা, শৃঙ্খলা বোধ ও খেলাধুলার অভাব, শিক্ষা হতে ঝরে পড়া, সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়াসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
দেশে ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রম। তারা শুরু থেকেই নিজেদের মতো করে পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে একই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ, ইউজিসি দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যদিও এসব পরীক্ষার গুণগত মান নিয়ে সমাজে ব্যাপক আলোচন-সমালোচনা রয়েছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আজও অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করার কোনো সর্বজনীন পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারলাম না, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হতাশাজনক।
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তৃতীয় ঢেউ যদি আসে তাহলে কত দিন তা চলবে এসব নিয়ে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরাই এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে নিঃসন্দেহে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সচল করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ব। বিষয়টি নিয়ে আর বিলম্ব না করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে সমস্যা সমাধানে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। এ থেকে দ্রুত উত্তরণ না ঘটাতে পারলে একটা মেধাহীন প্রজন্ম তৈরি হবে দেশে।
শিক্ষাক্ষেত্রে যে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোদিনই পূরণ হবার নয়। এই করোনা মহামারিতে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে আমাদের, একই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বজনীন কার্যকর বিকল্প চালু করতে হবে, কোনো ধরনের অবহেলায় শিক্ষাকে পিছে ফেলে রাখা কোনো কাজের কথা না। করোনা যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে বন্ধের সময়সীমা আরও বাড়বে এটাই এখন পর্যন্ত চলতি ধারা। কিন্তু গৎবাঁধা এই ধারা কতটা সঠিক হচ্ছে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। দেশের সবকিছু যেমন সচল, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থাকেও কীভাবে সচল করা যায়, বিকল্প পদ্ধতিতে হলেও, তা এখনই ভাবা প্রয়োজন। সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটা যুৎসই সমাধানই পারে জাতির পরবর্তী প্রজন্মকে আলোকিত রাখতে।