রাত ১:১৭, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শান্তি নয়, রাজনৈতিক কারণেই নোবেল পেলেন ‘যুদ্ধবাজ’ মাচাদো?

স্বাধীনমত ডেস্ক
এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো। গত ১০ অক্টোবর বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারের বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা হতেই শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। অনেকেই মনে করছেন, ‘যুদ্ধবাজ’ মাচাদোর এ পুরস্কার শান্তি অবদানের চেয়ে রাজনৈতিক বার্তাই বেশি বহন করছে। বিশেষ করে, নিকোলাস মাদুরোর সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থানকে আরও জোরদার করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে এটি।

সমালোচকদের দাবি, যিনি গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং নিজ দেশে সরকার পতনের জন্য বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন—এমন একজন নেতার হাতে শান্তির নোবেল তুলে দেওয়া নোবেল কমিটির ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

কেন পেলেন নোবেল
নোবেল কমিটি মাচাদোকে ‘শান্তির প্রতীক’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, তিনি ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন অন্ধকার সময়েও। কমিটির চেয়ারম্যান ইয়র্গেন ওয়াতনে ফ্রিডনেস বলেন, তিনি একসময় বিভক্ত থাকা বিরোধী রাজনীতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, সাহসিকতার প্রতীক হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, গত বছর মাচাদোকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। প্রাণনাশের হুমকির মধ্যেও তিনি দেশ ছাড়েননি। যখন কর্তৃত্ববাদীরা ক্ষমতা দখল করে, তখন স্বাধীনতার সাহসী রক্ষকদের স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।

রাজনৈতিক বিতর্ক
মাচাদোর নোবেল পুরস্কার পাওয়া পশ্চিমা বিশ্বে ‘গণতন্ত্রের জয়’ হিসেবে উদযাপিত হলেও কিন্তু এটি দ্রুত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সমালোচকদের দাবি, মাচাদোর পুরস্কারটি শান্তির চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে বেশি যুক্ত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইসরায়েলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা এবং লাতিন আমেরিকায় পশ্চিমা স্বার্থকে সমর্থন করাই তার নোবেল জেতার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

পুরস্কার পাওয়ার পর সরাসরি ট্রাম্পের কাছে ফোন করেন মারিয়া কোরিনো মাচাদো, এমনকি পুরস্কারটি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে উৎসর্গও করেছেন। ট্রাম্পের দাবি, তার সম্মানেই নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন মাচাদো।

এর আগে অবশ্য ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কার না দেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেছিল হোয়াইট হাউজ। হোয়াইট হাউজের যোগাযোগবিষয়ক পরিচালক স্টিভেন চিউং এক্সে লেখেন, ‘নোবেল কমিটি আবারও প্রমাণ করেছে, তারা শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে বেশি প্রাধান্য দেয়।’

কী বলছেন মাচাদো
নোবেল পুরস্কার জেতায় দারুণ উচ্ছ্বসিত মারিয়া কোরিনা মাচাদো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘ভেনেজুয়েলাবাসীর সংগ্রামের প্রতি এই বিশাল স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের কাজ শেষ করার প্রেরণা জোগাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি এবং আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, লাতিন আমেরিকার জনগণ এবং বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ওপর নির্ভর করছি—স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আমাদের প্রধান মিত্র হিসেবে। ভেনেজুয়েলা মুক্ত হবে!’

ভেনেজুয়েলা সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বিরোধ
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল মজুতকারী দেশ, যার মোট প্রমাণিত রিজার্ভ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল। ১৯৯৯ সাল থেকে হুগো শ্যাভেজ এবং পরবর্তীকালে নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বে দেশটি সোশ্যালিস্ট নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি এবং আর্থিক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়। এছাড়া, মাদুরো সরকারকে ‘নারকো-টেরর কার্টেল’ বলে অভিহিত করে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলাকে মাদক পাচারের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে।

২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে বিরোধ নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন মোতায়েন করে তথাকথিত ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ শুরু করে। ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে অন্তত চারটি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার উপকূলে সন্দেহভাজন মাদক-পরিবহন নৌকায় আঘাত করে, যাতে ২১ জন নিহত হন।

বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মাচাদো
ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের জন্য বিদেশি শক্তির (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের) হস্তক্ষেপের পক্ষে কথা বলেছিলেন মাচাদো, যা শান্তি পুরস্কারের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

২০১৮ সালে তিনি ইসরায়েল ও আর্জেন্টিনার কাছে চিঠি লিখে মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আজ আমি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে আবেদন করছি, তারা যেন তাদের প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করে মাদক ও সন্ত্রাসে জড়িত ভেনেজুয়েলার অপরাধী সরকারকে ভেঙে দিতে সহায়তা করেন।’

গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন
যদিও মাচাদো কখনো প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞের পক্ষে কিছু বলেননি, তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর তিনি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানান। এরপর থেকে তার নানা পোস্টে দেখা গেছে, তিনি নিজেকে নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন।

এক পোস্টে মাচাদো লিখেছিলেন, ‘ভেনেজুয়েলার সংগ্রামই ইসরায়েলের সংগ্রাম।’ পরের এক পোস্টে ইসরায়েলকে বলেছেন ‘স্বাধীনতার প্রকৃত মিত্র।’ এমনকি তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবেন।

সমালোচনার ঝড়
নরওয়ের সংসদ সদস্য বিয়র্নার মক্সনেস বলেছেন, মাচাদো ২০২০ সালে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি সই করেছিলেন, যে দল গাজার গণহত্যার জন্য দায়ী। এমন প্রেক্ষাপটে এই পুরস্কার নোবেলের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুসলিম অধিকার সংস্থা কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস এক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তকে ‘অমানবিক ও অনৈতিক’ বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, নোবেল কমিটি এমন কাউকে সম্মান জানানো উচিত ছিল, যিনি গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিয়েছেন—যেমন শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, কর্মী বা চিকিৎসক যারা জীবন বাজি রেখে সত্যের পক্ষে লড়ছেন।

সব মিলিয়ে, একদিকে নোবেল কমিটি তাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে তার যুদ্ধপন্থি অবস্থান ও বিদেশি হস্তক্ষেপের আহ্বান—দুটোই শান্তি পুরস্কারের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন সমালোচকেরা।