সংস্কৃতি ধ্বংসের পাঁয়তারা ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

সংস্কৃতি ধ্বংসের পাঁয়তারা ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

কুদরত-ই-গুল
তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্ম নিল। মনে হলো নতুন এবং অসীম সম্ভাবনাময় দিগন্তের খিড়কির খিল খুলে গেল চকিতে। সবাই আশা করেছিল প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশের বেড়াজাল ভেঙে গেল। কিন্তু জন্মের পরপরই চরিত্র বদলাতে শুরু করল; পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মঞ্চে হাজির হলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির চরিত্রে। মঞ্চ প্রায় একই রকম থাকল, পরিবর্তন হলো কুশীলবের। ফলে সবার স্বপ্ন যেন দৈত্যের দুঃস্বপ্নের মতো গুমরে গুমরে ভেঙে গেল। অনুরাগের জায়গা ক্রমে দখল করল বিরাগ। পূর্ব পাকিস্তানের একদল প্রাজ্ঞ ‘মেধাজীবী’ এটি বুঝতে পেরে বলতে শুরু করলেন, এটি ব্রিটিশ উপনিবেশের সম্প্রসারণ মাত্র। এটি বুঝতে পেরেই কাজী নজরুল ইসলাম বোধ হয় বলেছিলেন, এটি পাকিস্তান নয়; হবে ‘পাপিস্তান’।

বলে নেওয়া দরকার, পাকিস্তানের মতো ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, নিজেদের আধিপত্যকে মজবুত করার জন্য কীভাবে হাজির হয়। তাদের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে জাতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করা। তারা অবশ্যই প্রথম প্রথম অস্ত্রের অস্তিত্ব জানান দেয় না। তারা দ্রুত বিস্ময়করভাবে সাংস্কৃতিক জীবনকে নানাখানা করতে চায়। তারা সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নিম্নমান আখ্যা দেয়। তারা এ কাজগুলো করে থাকে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক যন্ত্রের সহায়তায়। তারা ব্যতিক্রমহীনভাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকারের ভাষায় কথা বলা এজেন্টদের। আর অবশ্যই তাদের বিচিত্র প্রোপাগান্ডাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দোসর হিসেবে একশ্রেণির ‘মেধাজীবী’কেও তারা নিয়োগ দিয়ে থাকে; ‘ভূষিত’ করে থাকে নানা খেতাবে। এই সব ‘মেধাজীবী’ প্রায়ই প্রাসাদের প্রসাদভোগী হয়ে থাকেন।

আরেক শ্রেণির ‘মেধাজীবী’ থাকেন, তাঁরা অবশ্যই দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে সক্রিয়ভাবে কলম চালিয়ে যান। কখনো কখনো সশরীরে হাজির হন ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে এবং বুঝিয়ে দিতে। জাতি রক্ষার কান্ডারি হিসেবে হাজির হন তাঁরা। তাঁদেরই আমরা বলি জাতীয় বুদ্ধিজীবী বা ‘মেধাজীবী’।

এখন আসা যাক, ‘মেধাজীবী’ বা ‘বুদ্ধিজীবী’ কারা? প্রখ্যাত ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘তিনি “বুদ্ধিজীবী” নাম না দিয়ে “মেধাজীবী” নাম দিয়েছিলেন।’ কারণ হিসেবে বলেন, ‘সব মানুষই বুদ্ধি খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করে, বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। “ইন্টেলিজেন্স” ছাড়া মানুষের সরব, সচল অস্তিত্ব কি সম্ভব?’ তিনি আরও বলতে চান, ‘বুদ্ধি আর মেধা এক জিনিস নয়। বুদ্ধির সঙ্গে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এক হলেই সে মেধার চেহারা নেবে।’ এ কারণেই ‘মেধাজীবী’ শব্দটিই বেছে নেওয়া। ‘মেধাজীবী’ মূলত চলতি বিকৃতির মধ্য দিয়ে আসল আকৃতি আঁচ করতে পারেন বা ভবিষ্যৎকে দেখাতে পারেন। চলতি বিকৃতি কী ধরনের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা তিনি দেখিয়ে দেন। আবার তিনি দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না, বিকৃতিকে রুখে দিতে চান সক্রিয় প্রতিবাদ-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এর মাধ্যমে তিনি ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠিত হন না। এই অকুণ্ঠ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বই ‘মেধাজীবী’ হিসেবে বিবেচিত হন। আমরা যদি পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লব, আন্দোলনের দিকে তাকাই, দেখব তাঁরা নানা বিপন্নতার মধ্যেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন স্বমহিমায়। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এর ভালো উদাহরণ।

পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের এখানে যে আঘাতটি প্রথম করেছিল, তা ভাষার ওপর। বাংলার স্থলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী। ভাষার ইতিহাসই যদি মানুষের ইতিহাস হয়ে থাকে, তাহলে বাঙালির যাবতীয় সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিভূমি এই ভাষা। এই ভিত্তিভূমি ভাঙার চেষ্টাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

ভাষার ওপর আঘাত হানার কারণ কী? তা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আপাত খোলা চোখে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা নিরীহ মনে হলেও, তা আসলে কোনো ক্রমেই নিরীহ বিষয় নয়। কারণ, ভাষা হলো একটি জাতির সংস্কৃতি বিনির্মাণের প্রথম এবং প্রধানতম পাটাতন। নিজের বিকাশ এবং প্রকাশের একমাত্র হাতিয়ার। ভাষা-পাটাতনের ওপরই তো গড়ে ওঠে সংস্কৃতির বিশাল প্রাসাদ। তারা ভেবেছিল, যদি ভাষার আধিপত্যকে নস্যাৎ করা যায়, তাহলে সংস্কৃতির প্রাসাদ বিধ্বস্ত হতে বাধ্য। আর এই সংস্কৃতির প্রাসাদ রক্ষার তাগিদে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যাঁরা কলম ধরেছিলেন, তাঁরা আমাদের ‘মেধাজীবী’ সম্প্রদায়। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এই অস্বাভাবিক উদ্ভট রাষ্ট্রের হাত থেকে সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে না পারলে, আমরা একটা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হব। এই তাগিদে প্রথম দিকেই এগিয়ে এলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. এনামুল হক, আবদুল হক প্রমুখ। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি ভাষার সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবন তছনছ হতে বাধ্য। এটা টের পেয়ে আমাদের ‘মেধাজীবী’ কবি, সাহিত্যিকেরা পরবর্তী সময়ে একুশের সংকলন, একুশের ফেব্রুয়ারি (১৯৫৩) গ্রন্থটি প্রকাশ করেন; যা আমাদের এখানে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম গ্রন্থিত প্রকাশ। এই গ্রন্থিত প্রকাশই পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতিঘর হিসেবে কাজ করে।

পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ভাষার প্রশ্নে ব্যর্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের ওপর সাম্প্রদায়িক আঘাত করেছিল অকপটে। তাঁকে আঘাত করা হয়েছিল ‘হিন্দু কবি’ বলে। নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ সরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। ফলে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িকতার খপ্পরে পড়ে যায়। তারা আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সম্ভ্রম ও সার্বভৌমত্বকে নষ্ট করার অপতৎপরতায় মেতে ওঠে। এ ছাড়া ১৯৬১ সালে যখন বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের আয়োজন হচ্ছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই আয়োজনকে বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালায়। কিন্তু আমাদের ‘মেধাজীবী’ সম্প্রদায় এসব অপতৎপরতাকে রুখে দেন। তাঁরা জানতেন, এতে ঝুঁকি আছে। কিন্তু তাঁরা ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে তাঁদের কাজ চালিয়ে গেছেন। সাংবাদিকেরা লিখেছেন পত্রিকায়, কবি-সাহিত্যিকেরা লিখেছেন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। আর যাঁরা সাংগঠনিকভাবে তৎপর ছিলেন, তাঁরা নানা আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এই তুমুল নিপীড়নের মধ্যেও সুফিয়া কামাল, সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ছায়ানট’-এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন।

পূর্ব পাকিস্তানের ‘মেধাজীবী’ সম্প্রদায় বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান ধর্মকে সংস্কৃতি হিসেবে মূল্যায়িত করতে চায়। কিন্তু ধর্মই সংস্কৃতি নয়, এটা হতে পারে বড়জোর সংস্কৃতির সুস্বাদু ফল। আর পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক চরিত্র এত বিচিত্রতায় ভরা যে, তার কূল পাওয়া অত সহজসাধ্য বিষয় নয়। বহু সভ্যতা ও সংস্কৃতির পলি দিয়ে স্তরে স্তরে গঠিত এর ভূমি। ফলে এর ভাঁজে ভাঁজে তার সৌরভ জড়িত ও জারিত হয়ে আছে। সেই শক্তিই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করবে। এরই প্রসঙ্গ ধরে রবীন্দ্রনাথের ইমপিরিলিয়াজম গ্রন্থ থেকে ধার করে বলা যায়, ‘পৃথককে বলপূর্বক এক করলে তারা একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে’।

মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশা, জহির রায়হান প্রমুখ সাহিত্যিক এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন প্রমুখ সাংবাদিকসহ প্রায় ১ হাজার ২২২ জন শহীদ ‘মেধাজীবী’ এবং যাঁরা বেঁচে ছিলেন বা আছেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এই রাষ্ট্রচরিত্রের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতার সুর আছে। সেই সুরে তাঁরা রচনা করেছিলেন স্বাধীনতার গান। অবশেষে তাঁরা আত্মাহুতির মাধ্যমে স্থাপন করে গেছেন মেধাজীবিতার বিরল দৃষ্টান্ত। ‘মেধাজীবী’, যাকে আমরা অভিন্ন অর্থে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলি, তাঁদের নিধনের মর্সিয়াকালে এই মহান শহীদদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।

লেখক: কুদরত-ই-গুল প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ

More News...

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন আবশ্যক

পার্বত্য জেলায় ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই