আফগানিস্তান কি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের পথে?

আফগানিস্তান কি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের পথে?

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

আফগানিস্তান এখন অগ্নিগর্ভ। ইতোপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন আফগানিস্তান থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করবেন। তিনি বলেছেন, তার দেশের সৈন্যরা বিদেশে আর কত প্রাণ দেবে। তিনি আরও বলেছেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে ইউএসএ আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। কোন দেশ কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলবে, সে দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের নয়। বাইডেনের এমন বক্তব্যের অনেকেই কঠোর সমালোচনা করেছেন। কয়েক যুগের মধ্যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ রকম বাস্তব বক্তব্য দেননি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৯৪৬ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। জাপান সঙ্গে সঙ্গে নিঃশর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যত যুদ্ধে জড়িয়েছে, এটাই চূড়ান্ত এবং পূর্ণ বিজয়। জাপানের রাজা হিরোহিতোকে ক্ষমতায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র যতদিন প্রয়োজন জাপানে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে একচ্ছত্রভাবে। এরপর কোরিয়া যুদ্ধে হয়েছে ভাগাভাগি দেশটি। উত্তর কোরিয়া গলার কাঁটা। ইন্দোচীনে (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস) দিয়েন বিয়েন ফিউতে ফরাসিরা গ্লানিকর পরাজয় বরণ করলে সেখানকার সমস্যার সঙ্গে ইউএসএ, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন জড়িয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম দ্বিখণ্ডিত হয়, উত্তর অংশে কমিউনিস্ট নেতা হোচি চি মিন জেতেন এবং দক্ষিণ অঞ্চল ডিয়োময় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ঠিক হলো ভিয়েতনামের জনগণ ভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তারা কোন দিকে যাবে।

১৯৫৪ সালের তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন বললেন, এ প্রস্তাবে রাজি হওয়া যাবে না। কেননা, ডোমিনে ইফেস্টে পুরো অঞ্চল কমিউনিস্টদের দখলে যাবে। এভাবে সূত্রপাত হলো এ অঞ্চলের সংঘর্ষের। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাহিনি সর্বজনবিদিত। আটান্ন হাজার মার্কিন মায়ের কোল খালি হয় ওই যুদ্ধে। মার্কিন বাহিনী কেটে পড়ে। কম্বোডিয়ায় মার্কিন বাহিনী ঢুকল, আবার এক ভয়াবহ বাহিনী খেমার রোজের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সরে এলো। আর খেমার রোজের বর্বরতা হিটলারকে ছাড়িয়েছিল। কুয়েত পুনরুদ্ধার আমেরিকানদের অবদান। সেটা সম্ভব হয়েছিল গোটা বিশ্ব কুয়েত দখলকে নিন্দা করে এবং উদ্ধারের জন্য একাট্টা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এরপর ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে- এই মিথ্যা অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করল। সঙ্গে ছিল যুক্তরাজ্য। সাদ্দাম হেরে গেলেন। কী তার অপরাধ, তা জানা গেল না। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হলো। তাঁবেদার সরকার তাকে ঈদের দিনে ফাঁসিতে চড়াল। ইরাকে মার্কিন সরকার কর্তৃক আরোপিত গণতন্ত্র চলছে। তবে কতটা শান্তিতে আছে ইরাকবাসী, তা তো বিশ্ববাসী দেখছেই।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাতে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব আল কায়দা এবং তালেবানকে সব রকমের সামরিক সাহায্য প্রদান করে। কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। বিপুল অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। ফলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে গেল। ৯/১১-তে আল কায়দা বাহিনী এক ভয়াবহ আক্রমণ চালাল। বিশ্বের এক নম্বর সামরিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির মাথা হেঁট হয়ে গেল। ইতোমধ্যে উগ্র, ধর্মান্ধ ভয়াবহ তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেলো আফগানিস্তান। সেখানেই মূল আস্তানা আল কায়দার ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা ৯/১১-এর অভিযান চালিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো অবকাশ ছিল না আফগানিস্তান আক্রমণ করা ছাড়া। তাই ন্যাটো এবং অন্যান্য মিত্র বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করল। আল কায়দা এবং তালেবান উচ্ছেদ হলো। শেষ পর্যন্ত আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন ধরা পড়েন এবং কথিত আছে, তাকে হত্যা করার পর তার লাশ মহাসাগরে নিক্ষেপ করা হয়।

আজ প্রায় দুই দশক যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে। কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। প্রচুর মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য এসেছে। কিন্তু শান্তি আসেনি। নতুন করে তালেবানের হামলা চলছে। ইতোমধ্যে তালেবান দাবি করেছে, দেশটির ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে তারা ১০টি দখলে নিয়েছে। গজনি শহরও এখন তাদের কবজায়। আতঙ্কে কাবুলের দিকে ছুটছে মানুষ। অতীতে সেখানে এত আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে এবং একজন মার্কিন জেনারেল বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তালেবানদের সমস্যা হবে না সেখানে। আফগান সরকার এ কথা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি যে, তালেবান একটি শক্তি এবং তার সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তান। অতএব, ব্যাপকভাবে আলাপ-আলোচনা করে বৃহত্তম সরকার গঠন করা যায় কিনা, তা-ই তাদের ভাবা উচিত ছিল। তা না করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভর করে রইল। আফগান জাতি কোনো পরিবর্তন সহজে মেনে নিতে চায় না। মাঝে মাঝে এ রকম দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে, সরকারি বাহিনীর সৈন্যরা মিত্র বাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করেছে। বলা হচ্ছে, আমেরিকানরা চলে গেলে তালেবানরা আফগানিস্তান পুরোপুরি দখল করবে। বিদ্যমান পরিস্থিতি এ সাক্ষ্যই বহন করছে। জো বাইডেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। যুক্তরাষ্ট্র গত সত্তর বছরের বেশি সময়ে সামরিক দক্ষতা কতটা অর্জন করেছে তা তিনি অবহিত। আফগান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি আলাপ-আলোচনার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। বলেছেন, আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা প্রদান করবেন। প্রয়োজনবোধে সীমিত আকারে বিমান হামলা চালানো হবে। আফগানিস্তানের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে আকাশ হামলায় খুব একটা লাভ হবে না। আফগান সরকার, তালেবান এবং পাকিস্তান- এই তিন শক্তির সমন্বয়েও আলোচনার মাধ্যমে কোনো সরকার গঠন করা যায় কিনা তা-ই মনে হয় হবে যথাযথ। ইতোমধ্যে তালেবানরা ইরান এবং কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে। তালেবানদের পরিবর্তিত বিশ্বের আলোকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তা যদি না হয়, তাহলে শিরশ্ছেদতন্ত্র চলবে। একটা কথা উঠেছিল, তালেবানের প্রত্যাবর্তন ভারতকে বিপাকে ফেলবে। কেননা এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, পাকিস্তান কাশ্মীরের ব্যাপারে তালেবানকে ব্যবহার করবে।

আমরা জানি, তালেবানরা চরম ধর্মান্ধ। কোনো রকম পরিবর্তন বুঝতে চায় না। অথচ আরবের বিভিন্ন রাষ্ট্রে কত রকম পরিবর্তন এসেছে। তালেবানরা চায় মেয়েরা ঘরে থাকবে এবং পড়ালেখা করবে না। অথচ এবারের হজের সময় সৌদি আরবে নারী সেনা নামানো হয়েছিল। জানি না তালেবানের মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে কিনা। ইতোমধ্যে আশরাফ গনি নেতৃত্বাধীন সরকার তালেবানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তালেবানরা এখন কোন পথে যাবে তা বলবে ভবিষ্যৎ।

আফগানিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতি অনেক বার্তাই দিচ্ছে। তালেবানের উত্থান আমাদের কারোর জন্যই শুভপ্রদ হবে না। আফগানিস্তান একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এই আশঙ্কা অমূলক নয়। তালেবানরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রক্ত ঝরছে, ঘটছে প্রাণহানি। সেখানে মানবতা বিপন্ন-বিপর্যস্ত। মার্কিন সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি কোনদিকে যায়, দেখার বিষয় এখন সেটিই।

মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা; ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও বীমা খাত বিশ্নেষক

More News...

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন আবশ্যক

পার্বত্য জেলায় ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই