ভোক্তার স্বার্থে চাল আমদানি

ভোক্তার স্বার্থে চাল আমদানি

আব্দুল হাই রঞ্জু
বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এখন নিম্ন আয়ের মানুষদের বাড়তি দামে চাল কিনে খেতে কষ্ট হচ্ছে। যেহেতু বোরো ধান কাটা-মাড়াই সবে মাত্র শেষ হলো, সেহেতু চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। উল্টো নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছে না বরং প্রতিনিয়তই বেড়েই চলছে। যদিও চালের বাজার যে হঠাৎ করে বেড়েছে তাও না। দুবছর ধরে সরকারের আপৎকালীন চাল মজুদে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। বিশেষ করে, গত বছরে দফায় দফায় বন্যার কারণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় ধানের বাজারদর বেড়ে যায়। ফলে সরকার আপৎকালীন খাদ্য মজুদের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে ধান-চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেই তা সফল হয়নি। ফলে সরকারি চালের মজুদ কমে আসে এবং ভোক্তার কষ্ট বাড়তে থাকে, যা লাঘবে সরকার দুই দফায় চাল আমদানির শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে এনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় চালের বাজার বেশি থাকায় কাক্সিক্ষত পরিমাণ চাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে চড়াদামে ভোক্তাদের চাল কিনে খেতে হয়েছে সত্য, কিন্তু তীব্র খাদ্য সংকট হয়নি। তবে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি কার্যক্রম যেমন পরিচালনা করতে পারেনি, তেমনি সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতেও পারেনি। যদিও ধান-চাল উৎপাদনের তুলনায় সরকার যৎসামান্যই অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে থাকে, তবু সরকারের আপৎকালীন খাদ্য মজুদের গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে এ বছর বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণ ধানের উৎপাদন হয়েছে। আবার বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়নি। বরং ধান কাটা-মাড়াইয়ে সরকার যান্ত্রিকতার গুরুত্ব দেওয়ায় সময়ের আগেই হাওরের ধানসহ পুরো দেশের ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। সরকারও বিপুল পরিমাণ আপৎকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। গত বোরো মৌসুমের চেয়েও দাম বাড়িয়ে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও আট লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম এখনো চলমান আছে। প্রতি কেজি চালের সংগ্রহ মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহ মূল্য ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ফলে এ বছর ছোট-বড় সব চাল-কল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী মিলাররা চাল সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। আশা করা যায়, এ বছর অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ সফল হবে। ইতিমধ্যেই সরকারি খাদ্য মজুদও বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিসম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ মুহূর্তে ১৩ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন গমের মজুদ রয়েছে। যদিও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালের বাজারদর বেশি থাকার কথা স্বীকার করে বলেছেন, বৃষ্টির কারণে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে আমরা ওএমএস বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছি, ট্রাক সেল, ভিজিএফ কার্যক্রম জোরদার করেছি। আশা করি চালের বাজারদর কমে আসবে মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, করোনার মধ্যে মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। আর করোনার প্রভাব যেভাবে দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে চালের দাম আরও বাড়তে পারে। যে কারণে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকার আবারও বেসরকারিভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, যেহেতু চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে চালের দাম কম, সেহেতু এ মুহূর্তে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক ও সময়োচিত বলে আমরাও মনে করি। তবে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির পাশাপাশি জিটুজি পদ্ধতিতেও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কারণ কোনো পণ্যের বাজারদর যদি বাড়তে থাকে, তাহলে এর বিরূপ প্রভাবে রপ্তানিকারক দেশগুলোর বাজারদরও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে, আফ্রিকার দেশগুলোর খাদ্য সংকট খুবই তীব্র। গত বছর তো শুধু আফ্রিকার খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বেশি পরিমাণ চাল আমদানির কারণে পুরো দুনিয়ায় চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। আফ্রিকার খাদ্য সংকট এখনো বিদ্যমান আছে। ফলে এ বছরও একপর্যায়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। মানুষের জীবন ও জীবিকার এই মহা-সংকটকালে ব্যাপক পরিমাণ চাল অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের পাশাপাশি আমদানি করে হলেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মজুদ বাড়ানো উচিত। কারণ আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠী। যাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় মাপের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের কৃষি খাত অভাবনীয় সফলতা এসেছে সত্য। তবুও চাল আমদানির শুল্ক সাড়ে ৬২ থেকে ২৫ শতাংশে নয়, আরও বেশি কমিয়ে চাল আমদানি করা উচিত। কারণ আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ যেখানে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরকে অতিক্রম করেছে। সেখানে ১০/১৫ লাখ টন চাল আমদানি করা সরকারের জন্য কোনো সমস্যাই নয়। তবে উৎপাদকের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাক্সিক্ষত পরিমাণ চাল আমদানির পর আবার চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করতে হবে। মূলত পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণ ভোক্তা ও উৎপাদকের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। আমরা মনে করি, করোনার মহামারীকালে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় সরকারের চাল আমদানির সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত।

অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সর্বশেষ বোরো মৌসুমে প্রায় দুই কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা গত বছর ছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। অর্থাৎ এ বছর বোরোতে ৪ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হয়েছে। তাহলে চাহিদার পুরোটাই পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু চালের বাজারদর প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? এ ক্ষেত্রে তথ্য-বিভ্রাটের কথাও অনেকেই বলছেন। বাস্তবে সঠিক তথ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। সঠিক তথ্য ছাড়া সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অনেকাংশেই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ গত আমন ও বোরো মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন ও ব্যক্তিপর্যায়ে মজুদের তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তা সঠিক ছিল না বলে সে মুহূর্তে অনেক বিশেষজ্ঞই মন্তব্য করেছিলেন। কারণ যে পরিমাণ খাদ্য মজুদের কথা বলা হয়েছিল, তা সঠিক হলে খাদ্য সংকট এত তীব্র হওয়ার কথা ছিল না। যে কারণে একটি দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও ভোক্তার স্বার্থে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা একান্ত জরুরি। আমরা মনে করি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে মাঠপর্যায় থেকে সঠিক তথ্য সংগ্রহে আরও আন্তরিকভাবে কাজ করা উচিত। তাহলে উৎপাদনের ভিত্তিতে মজুদ, বিপণন এবং সামাজিক নানা চ্যানেলে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রেখে সরকারের পক্ষে কর্মকৌশল গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা যেমন সহজ হবে, তেমনি সাধারণ ভোক্তার স্বার্থও রক্ষা হবে।

লেখক : কৃষিবিষয়ক লেখক

More News...

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন আবশ্যক

পার্বত্য জেলায় ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই