মাননীয় মন্ত্রী, বড়লোক বাংলাদেশে আমি কোথায়?

মাননীয় মন্ত্রী, বড়লোক বাংলাদেশে আমি কোথায়?

লীনা পারভীন
“শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।” এই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো আমার নয়। আমাদের মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রীর। সম্প্রতি এই কথা বলে তিনি আলোচনার মধ্যবিন্দু হয়েছেন। আমিও মাননীয় মন্ত্রীর সাথে একমত। আমার আয় বাড়ছে তবে সেটা কল্পনাতেই বাড়ছে। আর তাইতো আমি টের পাচ্ছিনা। তবে যেটা টের পাচ্ছি সেটা হচ্ছে মাস শেষ হবার আগেই আমার আয়ের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বাজারে গেলে ব্যাগ খালি নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। সন্তানের পড়ালেখার খরচ, বিদ্যুৎ বিল, বাড়তি যাতায়াত খরচ, ব্যাংকের দেনা শোধ করার পর পরিবারের সুষম খাদ্যের চাহিদা মিটাতে গিয়ে আমি টের পাচ্ছি যে দিনে দিনে আমার চাহিদাকে সামলাতে হচ্ছে। আমার শখগুলোকে মেরে ফেলতে হচ্ছে। দিন চালাতে যেখানে আমাকে হিমশিম খেতে হয় সেখানে শখ দেখানোটা আমাকে মানায়না।

আমি টের পাচ্ছি যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। বাজারে কোন সবজি ৬০ টাকার নিচে নাই। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। আমার জীবনের টানাপোড়েন বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। কিন্তু এই বিষয়গুলো আপনি টের পাচ্ছেন না মাননীয় মন্ত্রী। কারণ এর কোনটাই আপনাদের টের পাওয়ার কথা নয়। গণমাধ্যমে সুখবরটা পেয়েছি যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে অংকের হিসাবে তা দাঁড়িয়েছে ২৫০০ ডলারের বেশি। আমরা ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। দারুণ সংবাদ। বেশ একটু আরামবোধ হচ্ছিল সংবাদটা পড়ে। মনে হচ্ছিল আমিতো এখন আর দারিদ্র্য পীড়িত বাংলাদেশের নাগরিক না।

বাহ! বেশ! একটা আরামের ঢেকুর এলো। কিন্তু হায়! এই সংবাদ পড়ার পর যখন আমার বেতনের হিসাবটা সামনে নিলাম তখন দেখি আমার বেতন আগে যা ছিল তাই আছে। এক পয়সাও বাড়েনি। আমার অন্য কোনো কোন আয়ের উৎস নেই। বাংলাদেশের প্রতিটা পরিবারে গড়ে যদি ৫ জন করেও সদস্য থাকে আর সেই পরিবারের যদি একজনই কেবল রোজগারী মানুষ থাকে তাহলে একবার ভেবে দেখবেন যে সেই পরিবারটি কী কী টের পাচ্ছে? কোথায় তার বড়লোকি দেখানোর সুযোগ?

বাংলাদেশ ধনী দেশ হবে। আমাদের আয় বাড়ছে। মাননীয় মন্ত্রী, আপনার কোন কথাতেই কোন ভুল নেই। কিন্তু এই যে শনৈঃ শনৈঃ। উন্নয়ন সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? কাদের কাছে জমা হচ্ছে সেটা কী টের পাচ্ছেন মাননীয় মন্ত্রী? আমি টের পাচ্ছি কারণ এই বাড়তি আয়ের কিছুই আমার হাতে আসছে না। কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের উন্নয়নের ফসল। কারা তারা? এটা কি দেখা দরকার না?

কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পাচার করে দিচ্ছে কারা মাননীয় মন্ত্রী? সেটা নিশ্চয়ই আমার মত সাধারণ মানুষ নয়। আমিতো আমার সামান্য লোনের টাকা একমাস পরিশোধ না করলেই ব্যাংকের লোক আমাকে জেলের ভয় দেখায়। তাহলে কোটি কোটি লোন নিয়ে পরিশোধ না করাদের কেন কিছু হচ্ছে না? দুই দিন পরপর টাকা পাচারের সংবাদ পড়লে অবশ্য ভালোই লাগে যে নিশ্চয়ই আমরা উন্নত হচ্ছি না হয় এতো টাকা পাচার হবে কোথা থেকে?

সংবাদ বলে করোনাকালে দেশে নতুন করে তিন কোটি লোক দারিদ্র্য সীমায় প্রবেশ করেছে। এরা কারা? তাহলে এই যে ঘুম থেকে উঠেই বড়লোক হয়ে যাওয়া এরা কোথায়? আপনি কি জানেন, দেশে এখন কত মানুষ বেকারত্বের জালে জড়িয়ে পড়েছে? ছোট থেকে বড় প্রচুর কর্মজীবী মানুষ এখন কর্মহীন দিন পার করছে। মাননীয় মন্ত্রী, আমি অতি সাধারণ মানুষ। আপনাদের অর্থনীতির জটিল জ্যামিতি আমার ছোট মাথায় ঢুকেনা কারণ আমার মাথায় কেবল একটাই হিসাব ঢুকে আর সেটা হচ্ছে আমার দিন চলছে না। দিনে দিনে আমার খরচ বাড়ছে কিন্তু আয় বাড়ছে না।

আমি অর্থনীতি বলতে বুঝি আমার সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় ও চাহিদামাফিক জিনিসপত্র কিনতে পারছি কি না। আমি কেবল বুঝি রাস্তায় চলতে গিয়ে আমাকে বাড়তি গাড়িভাড়া দিতে হচ্ছে না। আমি আমার বড়লোকি হওয়া বলতে বুঝি আমার সন্তানের চাহিদা ঠিকঠাক মিটাতে পারছি কি না। সপ্তাহে অন্তত একদিন বাসায় মাংসের যোগান করতে পারছি কি না। আমার পরিবারের শখগুলো মিটাতে পারছি কি না।

আমার বাসার কাজের মেয়েটা যখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,‘আপাগো আমরাতো না খাইয়া মইরা যামু। কারণ তার স্বামী করোনায় কাজ হারিয়েছে। এখনও কিছু জুটাতে পারেনি। সে বাসায় কাজ করে যা আয় করে সেটা দিয়েই চলছে তাদের তিনজনের সংসার। এতে কুলাতে পারছে না সে। তার দুই বছরের কন্যাটি দোকানের সামনে দিয়ে গেলেই এটা সেটা চায়, সে দিতে পারেনা। বলে, ‘পেটেতো ভাতই জুটেনা ঠিকঠাক আর মাইয়ার শখ মিটামু কী দিয়া?’

মাননীয় মন্ত্রী দয়া করে মাটিতে নেমে আসুন। আপনি হয়তো এখনও ঘুমিয়েই আছেন এবং সেই ঘুমেই আপনি দেখছেন বাংলাদেশের সবাই বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। এটা মশকরা ছাড়া আর কিছুনা। ঘুম থেকে উঠলেই হয়তো আপনি সঠিক চিত্রটা পেয়ে যাবেন। আপনিতো জনগণের নেতা। জনগণ আপনাদের দিকে তাকিয়ে। তাহলে আপনারাই যদি আমাদের হাঁড়ির খবরটা সঠিক না রাখেন তাহলে আর আমাদের যাওয়ার রাস্তাটা কোথায়?

মাননীয় মন্ত্রী, আপনি এমন এক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন যেখানে নির্ভর করে বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন ছক। তাহলে সেখানে বসে যদি আপনি একটি কল্পনার বাংলাদেশ দেখতে থাকেন তাহলে যে পরিকল্পনাটা মাপমতো হবে না। একটু কি খুঁজে দেখবেন, এতো এতো উন্নয়নের টাকা কোথায় যাচ্ছে? কারা তারা যারা ঘুম থেকে উঠেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছে? খুব জরুরি মাননীয় মন্ত্রী। খুব জরুরি এই কাজটি করা। আপনার ধারণার সাথে বাস্তবের ফারাকটা খুঁজে বের করতে পারলেই কেবল সঠিক বাংলাদেশকে চেনা যাবে। সূত্র : জাগো নিউজ

লেখক : কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

More News...

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়ন আবশ্যক

পার্বত্য জেলায় ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই