সন্ধ্যা ৬:৩২, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪৮ জেলায় ৪৩৫টি স্পটে পুলিশ ও যুবলীগ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ হওয়ার জন্য বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণ হওয়ার শর্ত রয়েছে।
তাজুল বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৪৮টি জেলায় ৪৩৫টি স্পটে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগ সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হত্যা করে এবং পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে নারী, শিশু, তরুণ ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।
গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় সোমবার (১৩ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় তিনি এসব কথা বলেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত যে হত্যাকাণ্ড, মানবতাবিরোধী অপরাধ- এটা ওয়াইড স্প্রেড (ব্যাপক মাত্রায়) ছিল। দেশজুড়ে এই আক্রমণটা করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, হাসিনার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চান। তিনি ও তার পরিবারকে দেবতার আসনে বসাবেন। আমি উন্নয়ন করতে চাই। প্রতিপক্ষকে রাখবো না। এটা তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক উদ্দশ্যে। বাংলাদেশে কথিত স্বাধীনতাবিরোধী থাকবে না, প্রতিপক্ষ থাকবে না। শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূজা হবে, বন্দনা হবে। একদলীয় শাসন হবে। মায়ের, বাপের নামে প্রতিষ্ঠান হবে। তার দাবি, দেশটা তো আমার বাপের, বাপ স্বাধীন করেছে।’ এগুলো ছিল স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্য।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিপুল সংখ্যক আসামি অপরাধী এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেছিল। যারা আহত এবং নিহত হয়েছেন তাদের সংখ্যাও বিপুল পরিমাণে। এই অপরাধগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি। বরং পরিকল্পিতভাবে, ব্যাপক ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় একই ধরনের অপরাধ বারবার করা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে করা হয়েছে। এটাকে বলা যায় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং সারাদেশে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। ১৪শ’র বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন।
তিনি বলেন, এই সংখ্যাগুলো প্রমাণ করে, আক্রমণটা ছিল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। আরেকটা শর্ত হচ্ছে সিস্টেম্যাটিক হতে হবে। সিস্টেম্যাটিক হওয়ার জন্য যে অপরাধের ধরন, এখানে রাষ্ট্রের রিসোর্স ব্যবহার করা হয়েছে। একটা পরিকল্পনার আওতায় একটা সুনির্দিষ্ট টার্গেটে এই অপারেশনগুলো পরিচালিত হয়েছে। সেই জিনিসটা যে এখানে হয়েছে সেটা আমরা সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আদালতের কাছে উপস্থাপন করেছি। এটা শুধু যে ওয়াইড স্প্রেড তাই নয়, একই সঙ্গে এটা সিস্টেম্যাটিকও ছিল।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের একপর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতেপুলিশের নৃশংসতা নিয়ে আদালতে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, ওইদিন হাসিনার পতনের পর কোনাবাড়ী থানা এলাকায় বিজয় মিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। মিছিলে অংশ নেন কলেজছাত্র হৃদয়। মুহূর্তেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়ে পুলিশ। সবাই জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন নিরাপদ স্থানে। হৃদয়কে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ধরে আনেন। ঘিরে রেখে তাকে লাঠি দিয়ে একজন আঘাত করতে এগিয়ে আসতেই আরেকজন হৃদয়কে চড় মারেন। হঠাৎ তাকে পেছন থেকে গুলি করেন কনস্টেবল আকরাম। এতেই প্রাণ হারান তিনি।
এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, কলেজছাত্র হৃদয়ের লাশটি রাতের আঁধারে গাজীপুরের কড্ডা নদীতে পুলিশ ফেলে দেয়। হৃদয়কে গুলি করার ব্যাপারে কনস্টেবল আকরাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সাক্ষীদের জবানবন্দির অংশবিশেষ ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত বলে যুক্তি তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অসমাপ্ত থাকা অবস্থায় শুনানি মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
এর আগে ৮ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১২ অক্টোবর দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনাল। সেই অনুযায়ী গতকাল রোববার সকালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে প্রসিকিউশন। আদালতে আসামি শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এর আগে, ৮ অক্টোবর প্রসিকিউশনের পক্ষে সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়।
আসামিরা পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়েই এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এর পরের ধাপই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্কের পরেই মামলাটি রায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজন আসামি। অপর দুই আসামি হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে মামুন পরে রাজসাক্ষী হিসেবে হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।