কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের অর্থায়নে দেশে এই প্রথম স্থানীয় ওয়ার্কশপে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার ডিজাইন ও তৈরি করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা।
এ ধরনের যন্ত্র বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে বড় ওয়ার্কশপ প্রয়োজন। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট স্থাপনের বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই যন্ত্রটি বাজারজাতকরণের জন্য একটি ভালো মেশিনারি উৎপাদক কম্পানিকে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
প্রকল্প পরিচালকের তত্ত্বাবধানে হারভেস্টারটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রির সাবেক উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এসএসও) ড. মো. আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, যন্ত্রটি উদ্ভাবনের সময় ১৯টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হয়েছে। এই যন্ত্র বা হারভেস্টারটির দাম আমদানি করা হারভেস্টারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কিন্তু প্রচলিত যন্ত্রের চেয়ে ধান কাটার সক্ষমতা অনেক বেশি এবং সময়ও কম লাগে।
কম্বাইন হারভেস্টারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কাদায়ও চলবে। এমনকি ছোট জমিতেও ব্যবহার করা যাবে। ফোর সিলিন্ডার মেশিন, তাই শব্দও অনেক কম হবে বলে দাবি গবেষকদের।
গবেষকরা জানান, কৃষকের ছোট ও কর্দমাক্ত জমি বিবেচনায় নিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে। এটি ৮৭ অশ্ব শক্তি সম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে চালিত হয়। এটি প্রতিবারে ১.৫ মিটার (কাটার প্রস্থ) জমির ধান কর্তন করতে পারে এবং স্টোরেজ ট্যাংকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত ধান সংরক্ষণ করতে পারে। উচু-নিচু ও কাঁদা জমিতে যন্ত্রটি সহজে চালনার জন্য ৩০০ মিমি গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স রাখা হয়েছে। যন্ত্রটির মোট ওজন ৩০০০ কেজি এবং ট্রাকশন লোড ২১ কিলোনিউটন/মিটার হওয়ায় সহজেই কাদাযুক্ত জমির ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও সংরক্ষণ করতে পারে।
এটি প্রতি ঘণ্টায় ৩-৪ বিঘা জমির ধান কাটতে পারে এবং ডিজেল খরচ হয় ৩.৫-৪ লিটার। যন্ত্রটি ব্যবহারে হারভেস্টিং লসও খুবই কম (শতকরা ১ শতাংশের কম)। স্থানীয় ওয়ার্কশপে যন্ত্রটি তৈরি করতে ১২-১৩ লাখ টাকা খরচ হয়।
যন্ত্রটি তৈরির পর লোড-আনলোড অবস্থায় ল্যাবরেটরিতে এর বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর বিএডিসি ফার্ম, চুয়াডাঙ্গায় ব্রির মহাপরিচালক, পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, বিভাগীয় বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক, আমদানিকৃত কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের চালক ও কৃষকের উপস্থিতিতে মাঠ পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। মাঠ পরীক্ষণে উপস্থিত সকল সদস্য যন্ত্রটির কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
প্রকল্প পরিচালকের তত্ত্বাবধানে প্রধান গবেষক হিসাবে ড. মো. আশরাফুল আলম এবং তার টিম নিরলসভাবে চেষ্টায় জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যন্ত্রের প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা যন্ত্রটি মাঠে পরীক্ষা করে ভালো ফলাফল পেয়েছি। দেশের খন্ডিত চাষের জমির ধান কাটতে এটি অধিক কার্যকর এবং আমদানি করা কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের তুলনায় তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টারটি দিয়ে দিনে ২০-৩০ বিঘা জমির ধান কাটা যাবে। জ্বালনি খরচও খুব কম। এক ঘণ্টায় জ্বালানি খরচ হবে চার লিটার।
মাঠ পরীক্ষণে এর কার্যকারিতা পরীক্ষার পর গবেষকরা গত ৩১ ডিসেম্বর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার প্রত্যক্ষ করে মন্ত্রী বলেন, ব্রির বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেশের জন্য উপযোগী কম্বাইন হারভেস্টার উদ্ভাবন করেছে যেটির ইঞ্জিন ও ক্রলার বাদে সকল পার্টস স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি করা হয়েছে। যন্ত্রটির কার্যক্ষমতাও বেশি। কৃষকের ছোট জমিতেও সহজে চালনা করা যাবে। আমি মনে করি, স্থানীয় কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারীদের সক্ষমতা এবং ব্রির বিজ্ঞানীদের ডিজাইন ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি যন্ত্রটি প্রস্তুত করি তবে এটি হবে আমাদের অসাধারণ সাফল্য। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যেগে এ দেশে এসেম্বরি লাইন তৈরি করতে পারলে স্বল্প মূল্যে যন্ত্রটি প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রির বিজ্ঞানীরা যে কম্বাইন হারভেস্টার তৈরি করেছেন সরকারের নীতি ও আর্থিক সহায়তা পেলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে এবং বিদেশেও রফতানি করা যাবে।
তিনি বলেন, ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং ব্রির সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের কৃষকের জন্য এক অনন্য উপহার। দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার বিপ্লব ঘটাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।