পার্থিব জীবন ও পরকাল

পার্থিব জীবন ও পরকাল

মুহাম্মদ ইকরামুল ইসলাম : ‘সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না।’ জীবন থেকে সময় একবার অতিক্রান্ত হলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই মানবজীবনকে প্রবহমান নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। নদী যেমন থেমে থাকে না, তেমনি মানবজীবনের কোনো মুহূর্তই স্থির থাকে না। এর ক্ষয় আছে, আছে পরিসমাপ্তি। সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে নতুন ও অভিনব অনেক কিছু আবিষ্কৃত হলেও সময় ধরে রাখার কোনো যন্ত্র এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এজন্য মানুষের জীবনে সময়ের গুরুত্ব ও মূল্য সবচেয়ে বেশি। জীবনকে সার্থক করতে হলে সময়ের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। সময়ের শপথ করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্য ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ সুরা আসর : ১-৩

একবার হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, ‘ভাগ্যবান কারা? তিনি বললেন, ভাগ্যবান তারা, যারা দীর্ঘায়ু লাভ করেছে এবং তা নেক-আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, দুর্ভাগা কারা, তিনি বললেন, দুর্ভাগা তারা, যারা দীর্ঘায়ু পেয়েছে এবং তা বদ-আমলে কাটিয়েছে কিংবা আমলবিহীন অতিবাহিত করেছে।’ তিরমিজি : ২৩২৯

অনন্তকালের এক জীবন পরকাল। পরকালের পাথেয় সংগ্রহের জায়গা দুনিয়া। পরকালীন সুখ-শান্তি ও দুঃখ-কষ্টনির্ভর করে দুনিয়ায় মানুষের কাজকর্ম ও জীবনাচার। মানুষের সৃষ্টি এবং তাকে দুনিয়ায় পাঠানো কোনো নিরর্থক বিষয় নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য জোগাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জীবিকাদাতা, শক্তির আধার, পরাক্রান্ত।’ সুরা আজ জারিয়াত : ৫৬-৫৮

নির্দিষ্ট একটি গন্ডি ও সীমারেখার মধ্য থেকে মানুষকে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করতে হবে। দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ আলোচনায় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বৈ তো কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত।’ সুরা আনকাবুত : ৬৪

আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজসজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন : এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটো হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি।’ সুরা হাদিদ : ২০

কোরআনে কারিমে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলাপ্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।’ সুরা আল ইমরান : ১৮৫

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী। আর তুমি নিজেকে একজন কবরবাসী বলে গণ্য করবে।’

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের অপেক্ষা করো না, আর যখন তুমি সকালে উপনীত হবে তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও এবং মৃত্যুর আগে তোমার জীবনকে মূল্যায়ন করো।’ সহিহ বোখারি : ৬৪১৬

দিন, মাস ও বছর শেষে মানুষ অনেক কিছুর অঙ্ক কষে। বিগত সময়ের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করে আগামী দিনের পরিকল্পনা আঁকে। বৈচিত্র্যময় এ দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহ এবং দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক সময় মানুষকে আল্লাহর ভয়, মৃত্যুর স্মরণ ও কেয়ামতের চিন্তা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। মুমিনের জীবন কখনো এমন হতে পারে না। আল্লাহর স্মরণ ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের কল্পনা মুমিন হৃদয়কে সব সময় জাগরূক রাখে। আল্লাহ মুমিনদের সম্বোধন করে বলেন, ‘মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে খবর রাখেন।’ সুরা হাশর : ১৮

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের জীবনের প্রত্যাশা করে সে পার্থিব শোভা-সৌন্দর্য পরিহার করে।’ সুনানে তিরমিজি : ২৩৮২

দুনিয়ায় মানুষের বেঁচে থাকতে হলে আহারের প্রয়োজন রয়েছে। আর এজন্য জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম তাকে গ্রহণ করতে হয়। এটা দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম। আল্লাহকে স্মরণ রেখে বৈধপন্থায় জীবিকা উপার্জনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ সুরা জুমআ : ১০

আল্লাহতায়ালার ভয়, মৃত্যুর স্মরণ ও আখেরাতের ভাবনা মানুষের পার্থিব ও পরকাল জীবনকে সার্থক করে তোলে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার সব চিন্তাভাবনা একমাত্র আখেরাতের চিন্তায় বিলীন করে দেয়, আল্লাহ তার দুনিয়ার সব চিন্তার ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’ ইবনে মাজাহ : ৩৩৩০

হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘হে বনী আদম, তুমি আমার ইবাদতের জন্য সব ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্ত হও, তাহলে আমি তোমার অন্তর প্রাচুর্যপূর্ণ করে দেব।’ তিরমিজি : ২৪৬৬

More News...

শাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলত

চাঁদ দেখা যায়নি, ব্রুনাই-মালয়েশিয়ায় রোজা শুরু মঙ্গলবার