মাদক মামলায় খালাস অর্ধেকের বেশি আসামি

মাদক মামলায় খালাস অর্ধেকের বেশি আসামি

নিজস্ব প্রতিবেদক : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে গ্রেফতার দুই
২০০৫ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর সূত্রাপুরে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালানো ওই অভিযানে মো. ওমর আলী নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে হেরোইন জব্দ করা হয়। পরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তার বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় মামলা হয়। ১৭ বছর পর ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তাতে বেকসুর খালাস পান আসামি ওমর আলী।রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেননি। জব্দ তালিকায় থাকা একজন সাক্ষীও আদালতে আসেননি। আসামির বিরুদ্ধে এজাহার ও চার্জশিটে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাও যথাযথভাবে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষীর অভাবে মামলা থেকে আসামি খালাস পেয়ে গেছেন।
মামলার মূল ভিত্তি হলো এজাহার। এজাহারটা সঠিকভাবে হলে পরে সঠিক তদন্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে হবে। এজাহার যদি ঠিক না হয়, চার্জশিটও এলোমেলো হয়ে যায়। এগুলো যদি সঠিক এবং আদালতে ভালোভাবে সাক্ষ্য দেওয়া হয়, তাহলে মামলার বিচারও ঠিকঠাকভাবে করা সম্ভব হবে। অন্যথায় আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারেন। ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর একই আইনের আরেকটি মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ২০০৭ সালে করা এ মামলায়ও বেকসুর খালাস পান আসামি। ১৫ বছর ধরে বিচারকাজ চলার পর আসামির খালাসের পেছনেও সেই একই দুর্বলতা। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় খালাস পেয়েছেন মাদক মামলার আসামি।
শুধু এ দুটি মামলা নয়, গত ১৪ বছরে সারাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা অর্ধেকের বেশি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে গেছেন। ত্রুটিপূর্ণ এজাহার, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতা, তদন্তে গাফিলতিতে অপরাধীরা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। এমনকি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও অনেক সময় আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৯-২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে সারাদেশে অধিদপ্তরের করা ৩২ হাজার ৪৮০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৪৩৪টি মামলা থেকে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়া আসামির সংখ্যা ১৮ হাজার ৩৩৫ জন, যা মোট আসামির ৫২ দশমিক ২ শতাংশ।
নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসংখ্য মামলায় বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি, যা মামলার অন্যতম দুর্বলতা। আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা যথাযথভাবে তৈরি করা হয়নি অনেক মামলায়। আবার জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল। বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যেও অমিল রয়েছে অসংখ্য মামলায়। এর বাইরে রয়েছে সাক্ষী হাজির করতে না পারা, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে না আসার মতো ঘটনাও। বছরে এক লাখের বেশি মাদক মামলা
১৯৯০ সালে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। একই বছর প্রতিষ্ঠা করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে এ অধিদপ্তর। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে অবৈধ মাদক জব্দের পাশাপাশি মামলাও করছে অধিদপ্তর।
এদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড মিলে ২০২২ সালে মাদক অপরাধ সংক্রান্ত এক লাখ ৩২১টি মামলা করেছে। এতে আসামি এক লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ জন। তবে বিশেষায়িত সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামলায়ই যেখানে ৫২ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যান, সেখানে অন্য বাহিনীর করা মামলায় আসামি খালাসের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবে আরও বেশি।
আইনে ক্ষমতা থাকলেও কর্মকর্তাদের গাফিলতি!
দেশে বিদ্যমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ক্ষমতা দেওয়া হলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। ফলে অভিযান, তল্লাশিকালে মাদকদ্রব্য জব্দ এবং আসামি গ্রেফতার করলেও শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ঘাটতিও এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর ২১ ও ২৩ ধারা অনুযায়ী- মাদকদ্রব্য উদ্ধারে সবক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যে কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা কোনো চলাচলকারী যানবাহনে তল্লাশি, অবৈধ মাদকদ্রব্য জব্দ ও অপরাধে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করতে পারবেন।
এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, তল্লাশি করার আগে ওই এলাকার দুই বা ততোধিক সম্মানিত বা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে উপস্থিত থাকতে আহ্বান করা বা লিখিত আদেশ দেওয়া, তাদের সামনে তল্লাশি করে মাদকদ্রব্যের তালিকা তৈরি করতে হবে। পরে তাতে উপস্থিত ব্যক্তিদের সই নিতে হবে ও সাক্ষীদের সই করা জব্দ তালিকার পুরো কপি উপস্থিত দাখিলদারকে দিতে হবে। তবে আইনের এসব বিধান সঠিকভাবে মানছেন না দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। পাশাপাশি মামলার এজাহার, তদন্ত ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে না আসা এবং আদালতে ভুল সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। আসামিদের খালাসের পেছনে এসব গাফিলতিকে দায়ী মনে করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও। মামলায় ভুলের কারণে আসামিরা যাতে খালাস না পান, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটা আরও বাড়ানো হবে। এরইমধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে এ ধরনের সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মো. আবদুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো মামলার বিচার হয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। সাক্ষীরা যদি ঠিকমতো সাক্ষ্য না দেন বা মামলায় যখন ভুল থাকে, সেক্ষেত্রে আদালতের কিছু করার থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, সাক্ষীরা আদালতে এসে বলেন যে, যে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে, তা আমার সামনে উদ্ধার হয়নি। এটা তো ভুলভাবে সাক্ষ্য দেওয়া। ফলে এ সাক্ষ্য কাজে আসে না।’
তিনি বলেন, ‘আরও একটি ব্যাপার আছে, মামলার মূল ভিত্তি হলো এজাহার। এজাহারটা সঠিকভাবে হলে পরে সঠিক তদন্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে হবে। এজাহার যদি ঠিক না হয়, চার্জশিটও এলোমেলো হয়ে যায়। এগুলো যদি সঠিক এবং আদালতে ভালোভাবে সাক্ষ্য দেওয়া হয়, তাহলে মামলার বিচারও ঠিকঠাকভাবে করা সম্ভব হবে। অন্যথায় আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারেন।’
যা বলছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাগুলো যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে চলে, সেজন্য অনেক বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা চাকরিজীবন থেকে অবসরে চলে যান। আবার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখানোর ঘটনাও ঘটে বলে দাবি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের।অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অভিযান) মো. আহসানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক কর্মকর্তাই মামলার বিচারকাজ চলাকালে অবসরে চলে যান। তিনি সময় করে আর আদালতে সাক্ষ্য দিতে যেতে পারেন না। আবার তল্লাশিকালে যাদের সাক্ষী করা হয়, তারা পরবর্তীসময়ে সাক্ষ্য দিতে আসতে চান না। স্থানীয়ভাবে তাদের বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতি দেখানো হয়। এসব কারণে অনেক আসামি খালাস পেয়ে যান। তবে এসব ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে জানিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এ উপ-পরিচালক বলেন, ‘মামলায় ভুলের কারণে আসামিরা যাতে খালাস না পান, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটা আরও বাড়ানো হবে। এরইমধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে এ ধরনের সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।’

More News...

ট্রেনে ঢাকায় ফিরছেন অনেকে, স্টেশনে ভিড়

দ্বীপ উন্নয়ন-কৃষি জমি সুরক্ষা আইন করতে সংসদকে হাইকোর্টের পরামর্শ