কাজী মোঃ আব্দুল মান্নান, গাজীপুর : টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আগামী ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারী প্রথম পর্ব এবং ২০ থেকে ২২ জানুয়ারী দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে চলছে বিশ্ব ইজতেমায় আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ওযু, গোসল, থাকা, খাওয়া এবং অংশ গ্রহনের জন্য প্রস্ততি কাজ। সোনাবানের শহর খ্যাত টঙ্গীর কহর দরিয়া তুরাগ নদের তীরে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব মুসল্লিম উম্মাহ ও তাবলীগ জামায়েতের ৫৫তম গণজমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। মুসলমানদের এ মহাসমাবেশে আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানে প্রায় ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান আয়োজক কমিটি। গতকাল বৃহস্পতিবার ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রস্তুতি কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১৬০ একর বিস্থৃত এলাকা জুড়ে ইজতেমা ময়দানে বিশাল সামিয়ানা টানানোর কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। তবে ময়দানের বেশ কিছু জায়গায় টানানো পুরোনো সামিয়ানা ছিঁড়ে ঝুলে পড়তে দেখা গেছে। এছাড়াও খিত্তা ভিত্তিক চলছে মাইক বাধাঁ ও বৈদ্যুতিক তার ও বাতি টানানোর কাজ। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দেশে বিভিন্ন জেলা থেকে তাবলীগ জামাতের অনুসারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর কাজে যোগ দিতে ময়দানে এসেছেন। ময়দানের প্রস্ততি কাজ শেষে আগামী ১৩ জানুয়ারী ২০২৩ সালের প্রথম পর্বে তারা অংশ নিবেন এবং তাবলীগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শুনবেন। সেই সাথে ইসলামের দাওয়াতী কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়ার জন্য মুসল্লিরা জামাত বদ্ধ হয়ে ১, ২, ৩ চিল্লায় বেরিয়ে যাবেন। এদিকে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে শিল্পাঞ্চল খ্যাত টঙ্গীর আবাসিক বাসা বাড়িতে চলছে সাজ সজ্জার কাজ আর গৃহীনিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন ঘর গোছানো ও আত্বীয় স্বজনসহ বন্ধু-বান্ধবদের থাকা খাওয়ার আপ্যায়নে প্রত্যাশা নিয়ে।
ইজতেমা ময়দান সূত্রে জানা যায়, ইজতেমার দুই পর্বের প্রথম পর্ব শুরু আগামী ১৩ জানুয়ারী ২০২৩ শুক্রবার প্রথম ধাপ আম-বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারী আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। মাঝখানে ৪ দিন বিরতির দিয়ে ২০ জানুয়ারী শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে ২২ জানুয়ারী আখেরী মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে ২০২৩ ইং সালের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপ। ইজতেমা ময়দানে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকা থেকে কাজ করতে মো. সুলতান উদ্দিন (৬৫) জানান, আল্লাহর নৈকঠ্য লাভের আশায় তিনিসহ ২৫/৩০ জনের একটি দল গত ১৫ বছর যাবৎ এই ময়দাননে কাজ করছেন। শীত কোন বাঁধা নয়। স্বতর্স্ফুত ভাবে ময়দানের উন্নয়ন কাজ চলছে। যতদিন বেঁচে থাকবেন তিনি এভাবেই কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইজতেমা ময়দানের মুরব্বী মাওলানা জোবায়ের অনুসারী মো. আব্দুর শুক্কুর মাহমুদ (৬৮) জানান, বিদেশী ওলামা মাশায়েখরা বিশেষ করে বিদেশী মেহমান সৌদি অঅরব, মালয়েশিয়া ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরা এ দেশে অবস্থান করে দাওয়াতী কাজ করছেন। ইজতেমা ময়দানের সব কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল-এমপি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরণ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদ্বয় প্রতিদিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ময়দানের বিভিন্ন কার্যক্রমের খোঁজখবর নেয়াসহ বিভিন্ন ভুমিকা পালন করছেন। ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরণ জানান, আগামী ১০ জানুয়ারীর মধ্যে ইজতেমা ময়দানের সর্ম্পূণ কাজ শেষ হবে। ইজতেমা সফল করার জন্য সিটি কর্পোরেশনে পক্ষ থেকে সব ধররে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। ময়দানে বালি ফেলা, ময়লা আর্বজনা পরিকার পরিচ্ছন্নসহ বিভিন্ন উন্নয়ণমূখী কাজ চলছে। তিনি প্রায় প্রতিদিন ময়দানের খোজঁ খবর নিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল-এমপি জানান, ইজতেমা ময়দানে আসা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা যাতে কোন ধরনের অসুবিধায় না পড়েন তার জন্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি, নিরাপত্তার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনী, চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। ময়দান পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ইজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারি প্রথম ধাপে অংশ নেয়া মুসল্লিদের জন্য খিত্তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ৬৪ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিতে পারবেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ও ব্যবসায়ীসহ কলকারখানার শ্রমিক-মালিক এবং বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ আল্লাহ বিশেষ রহমত হাসিলের আশায় বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে কাজ করছেন। কেউ প্যান্ডেলের চট টানাচ্ছেন, কেউ খুঁটি পুঁতছেন, কেউ কেউ বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দিচ্ছেন, কেউ মাঠ পরিস্কার করছেন। ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দান প্রস্তুতির প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ময়দানে মুসুল্লিদের কাতারবদ্ধ হওয়ার জন্যে পুরো ময়দানের দাগ কাটা সম্পন্ন হয়েছে।
ইজতেমা ময়দানের উন্নয়ন কাজে অংশ গ্রহনকারী নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জ থানার বাসিন্দা মো. আলমগীর হোসেন (৩৫) জনান, ইজতেমার মাঠ প্রস্তুতির কাজ তাবলীগের মুরুব্বীদের তদারকিতে হচ্ছে। সব কাজ করা হচ্ছে মোশাহারার (পরামর্শ) মাধ্যমে। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরী, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। বিদেশী মুসল্লিদের থাকার জন্য ইজতেমা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে বিশেষ কামরা তৈরীর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ইজতেমার বয়ান স্টেজ তৈরিসহ সেটিকে রং দিয়ে সাঁজানো হচ্ছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লীদের ওজু, গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্যে ইজতেমা ময়দানে গভীর নলক‚পের মাধ্যমে প্রতিদিন সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। ওজু-গোসলের হাউজ ও টয়লেটসহ প্রয়োজনী স্থানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। ময়দানে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্থ অজু গোসলখানা এবং টয়লেটগুলো ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। ময়দানের চাহিদা মোতাবেক শতাধিক ড্রাম বিচিং পাউডার সরবরাহ করা হবে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রায় অর্ধশত চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ইজতেমা চলাকালে প্রতিদিন গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপরাসণ কার্যক্রম চালানো হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চান্দনা-চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, রাস্তার উপর পার্কিং করা গাড়ি সরানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইজতেমা মাঠের চারপাশের রাস্তার ধূলাবালি নিয়ন্ত্রনে পানি ছিটানোর জন্য গাসিক এর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে প্রসাশন। বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত হয়ে পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশসহ এবার পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী কাজ করবে। পুলিশ ও র্যাবের অর্ধশত সিসি ক্যামেরা মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা মনিটরিং করা হবে।
এছাড়া বাইনোকুলার, মেটাল ডিটেক্টর, কন্ট্রোল রুমও স্থাপন করা হচ্ছে। ইজতেমা মাঠের বিভিন্ন স্থানে র্যাব ও জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া ইজতেমা ময়দানের চার পাশের সকল অবৈধ স্থাপনা ও দোকানপাট জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইজতেমাকে কেন্দ্র করে ইজতেমা ময়দানের উত্তরে নিউ মন্নু টেক্সটাইল মিলস প্রাঙ্গন, নিউ অলিম্পিয়া, হোন্ডা রোড, আই আর আই রোড এলাকায় অস্থায়ী ভাবে বাজার বসিয়ে ভিট প্রতি ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ভিট প্রতি নগদ এবং ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা প্রতিদিন ভাড়ায় বিভিন্ন পন্য-সামগ্রীর দোকানপাট এবং আলাদা ভাবে বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবসা বসাতে বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা আয়োজকরা জানান, বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ সার্বিক প্রস্তুতির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রথম পর্বের ইজতেমা শুরুর ২/৩ দিন আগেই সকল প্রস্তুতি শেষ হবে ইনশাল্লাহ্।