দ্বীন-দুনিয়ার পরিশুদ্ধি

দ্বীন-দুনিয়ার পরিশুদ্ধি

শায়খ ড. উসামা আবদুল্লাহ খাইয়াত : নেককার বান্দাদের চূড়ান্ত প্রত্যাশা ও হৃদয়ের আকাক্সক্ষা হচ্ছে দ্বীন-দুনিয়ার পরিশুদ্ধি অর্জন। কারণ এর মাধ্যমে বান্দার সৌভাগ্য পূর্ণ হয়। কৃতকার্য হওয়ার সবসূত্র এখানে একীভূত। তাই এসব চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলোকে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি দোয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে বলেন, ‘আল্লাহুম্মা আসলিহ লি দিনি আল্লাজি হুয়া ইসমাতু আমরি, ওয়া আসলিহ লি দুনইয়া আল্লাতি ফিহা মাআশি, ওয়া আসলিহ লি আখিরাতি আল্লাতি ফিহা মাআদি, ওয়াজআলিল হায়াতা জিয়াদাতাল-লি ফি-কুল্লি খায়রিন, ওয়াল মাউতা রাহাতাল লি মিন কুল্লি শাররিন।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! দ্বীনকে আমার জন্য পরিশুদ্ধ করে দিন, যার মধ্যে রয়েছে সমুদয় কার্যাদির আত্মরক্ষার নিশ্চিত উপায়। সংশোধন করে দিন আমার পার্থিব জীবনকে, যাতে গচ্ছিত রয়েছে জীবিকা। আমার আখেরাতকে বিশুদ্ধ করে দিন, যেখানে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আমার জীবনকে সর্বাপেক্ষা অধিক মঙ্গল কাজের মাধ্যম করে দিন। অনিষ্ট থেকে মুক্ত করে মৃত্যুকে শান্তির মাধ্যম করে দিন। সহিহ্ মুসলিম : ২৭২০

নবী কারিম (সা.)-এর পবিত্র জবান থেকে উচ্চারিত ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া এটি। যা বান্দার দুনিয়া-আখেরাতের প্রার্থিত সব কামনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বীনের মধ্যে নিহিত সাফল্য তো সেটি, যাকে আঁকড়ে ধরে বান্দা পদস্খলন থেকে আত্মরক্ষার সুযোগ পায় ও পদ ভ্রষ্টতা থেকে নিরাপদে থাকে।

সফলতার মূলভিত্তি রাখা হয়েছে আকিদা ও বিশ্বাসের জায়গা পরিশুদ্ধির মাধ্যমে। যেমন, একনিষ্ঠ তাওহিদ তথা একত্ববাদকে একমাত্র আল্লাহর জন্য স্থির করা। পূর্ণ উদ্যম ও চেতনা নিয়ে আল্লাহর পানে এগিয়ে যাওয়া এবং দাসত্বকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা তাওহিদের অন্যতম দাবি। তাছাড়া ইবাদতের যত প্রকার আছে, তার সব অঙ্গনে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা। আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা থেকে বিরত থাকা শুধু এই ভয়ে, তার অতীতের সব আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। পুণ্যের কাজগুলো বিফলে যাবে। তাই যত পুণ্য কর্ম আছে, সবগুলো দিয়ে নিজের জীবনকে আলোকিত করা। পাশাপাশি সব ধরনের মন্দ ও গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। প্রকৃত সফল তো সে, যে নিজের দ্বীন ও ইমানের পরিশুদ্ধি এবং রবের আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরকে পবিত্র করেছে। অপরদিকে সেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যে মন্দ কাজ করেছে এবং গর্হিত কাজ করে নিজের অবস্থানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। যেমনটি কোরআনে কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘সেই সফলকাম হবে, যে নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে।’ সুরা শামস : ৯-১০

বান্দার দ্বীন ও ইমান পবিত্রকরণের অন্যতম মাধ্যম হলো, নবী কারিম (সা.) কর্র্তৃক প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করা। তবে তা হতে হবে সুন্নাহ পালনের মাধ্যমে। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। সেই সঙ্গে তার আনীত দ্বীনের মধ্যে বেদআতের প্রসার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তার পথ ও শরিয়তের বিরোধিতা থেকে সাবধানতা অবলম্বন কাম্য। কোরআনে এসেছে, ‘সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের ভয় করা উচিত, না জানি তাদের ওপর কোন বিপদ আপতিত হয় অথবা যন্ত্রণাদায়ক কোন শাস্তি তাদের গ্রাস করে।’ সুরা নুর : ৬৩

দুনিয়ার সফলতার ভিত্তি হলো, রিজিকের মধ্যে প্রাচুর্যতা লাভ হওয়া। যেমন, স্ত্রী ও সন্তানের মতো নেয়ামত লাভ, সমাজে নিজের মর্যাদা উঁচু হওয়া, অন্তর প্রফুল্ল থাকা, বরকতময় জীবন লাভ, শারীরিক সুস্থতা এবং নিজ দেশে নিরাপত্তা লাভের মতো বিষয়াদি। যেমনটি নবীজি (সা.) বলেন, ‘ তামাদের মধ্যে যে লোক পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয়, সুস্থ শরীরে দিনাতিপাত করে এবং তার নিকট সারা দিনের খোরাকি থাকে, তবে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াটাই একত্রিত করা হলো।’ তিরমিজি : ২৩৪৬

হাদিসে উল্লিখিত যথেষ্ট পরিমাণ রিজিক দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, বান্দা এ পরিমাণ রিজিকপ্রাপ্ত হয়, যাতে কারও কাছে কিছু চাইতে না হয়। সেটি হলো, হালাল রিজিক এবং উপার্জনের সবচেয়ে ভালো অংশ। হারাম উপার্জনে কোনো সফলতা নেই। যেসব সম্পদ প্রতারণা, ধোঁকা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে অন্যায়ভাবে মানুষের লুণ্ঠিত সম্পদের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।

অপরদিকে আখেরাতের সফলতা হলো, আল্লাহ ওই বান্দার প্রতি দয়া করবেন, কিয়ামতের দিন তাকে সৌভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবেন; উন্নীত করবেন মুত্তাকিদের স্তরে। সে বান্দার হিসাব হবে খুব সহজ প্রক্রিয়ায়। অবশেষে পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে সে বান্দা চিরস্থায়ী আবাসস্থল জান্নাতে পৌঁছে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা সৌভাগ্যশীল, তারা থাকবে জান্নাতে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে যতদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করেন। এটা হবে এমন এক দান, যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।’ সুরা হুদ : ১০৮

শুরুতে উল্লিখিত নবীজির দোয়ার শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘যেন তিনি দুনিয়ার জীবনকে কল্যাণের পথে পরিচালিত হওয়ার একটি বিচরণকেন্দ্র করে দেন এবং থেকে যাওয়া আমলের প্রতিযোগিতার জন্য একটি ময়দান করে দেন।’ আর এটি সেই কথার প্রমাণ বহন করে, বয়স যতই বাড়–ক না কেন, আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দারা নিজেদের আমলের পাল্লা ভারী করার মানসে নিয়োজিত থাকতেন। এর সত্যায়ন করে সেই কথা, যেখানে নবীজি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে এবং মৃত্যু আসার আগে তার জন্য দোয়াও করবে না। কেননা কেউ মারা গেলে তার আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়। আর মুমিনের জীবন শুধু কল্যাণ বৃদ্ধিরই পরিচায়ক।’ সহিহ্ মুসলিম : ২৬৮২

কোনো একজন বান্দা যখন তার আমলের পাল্লা ভারী করার পেছনে ছুটে চলে, নিঃসন্দেহে তা তার জন্য কল্যাণকর। এসবের দেখাদেখি অন্যদেরও আগ্রহী হওয়া চাই এবং প্রত্যাশা করা উচিত। এই ব্যক্তির মৃত্যু যখন আসবে, তা তার জন্য ফেতনা থেকে শুরু করে যাবতীয় মন্দ ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ হবে। ফেতনার মুসিবতে পতিত হওয়া থেকে মৃত্যুর মাধ্যমে সে বেঁচে যায়। বিশেষ করে ব্যাধি খুব করে ছড়িয়ে পড়ে, দুর্বলতা প্রাধান্য পায় এবং সাহায্যকারী না পাওয়া যায়। সে জন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি দোয়ায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি যদি কোনো সম্প্রদায়কে ফেতনায় লিপ্ত করতে চান, তো আমাকে ফিতনামুক্ত করে (মৃত্যুর মাধ্যমে) আপনার কাছে নিয়ে নিন।’

নবী কারিম (সা.) থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত ও প্রমাণিত সব দোয়ার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একদিকে যেমন কল্যাণের বাহক, তেমনি তা যেকোনো অনিষ্ঠতা থেকে সুরক্ষা দানকারী। বান্দার উদ্দেশ্য পূরণে কার্যকরী। ব্যাপক অর্থবোধক এসব দোয়া নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে সচেষ্ট হওয়া এবং ধারাবাহিকভাবে অধিক পরিমাণে পাঠ করা। কেননা এসব দোয়া একটি নেক ওসিলা, যার মাধ্যমে কল্যাণ আসে দেরিতে কিংবা জলদি।

৩ ডিসেম্বর মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা।

অনুবাদ করেছেন নাজমুল হুদা

More News...

শাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলত

চাঁদ দেখা যায়নি, ব্রুনাই-মালয়েশিয়ায় রোজা শুরু মঙ্গলবার