ইরানে বাড়ছে ‘সাদা বিয়ে’

ইরানে বাড়ছে ‘সাদা বিয়ে’

অনলাইন ডেস্ক : বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে থাকাকে ইরানে বলা হয় ‘হোয়াইট ম্যারেজ’ বা সাদা বিয়ে। ইরানী সমাজের কড়া ইসলামী আইনে নারী-পুরুষের এভাবে একসাথে থাকা- বিয়ে ছাড়া যৌন সম্পর্কের মতোই- অবৈধ। কিন্তু তারপরও দেশটিতে এই সাদা বিয়ে বেড়ে চলছে।

ইরানে এখন বিয়ের আগেই একসাথে থাকছে এমন তরুণ যুগলের সংখ্যা কত তার কোন সরকারি হিসেব নেই। কিন্তু এটা ক্রমশঃই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে, এবং ইরানের কট্টরপন্থী প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।

বেশ কয়েক বছর আগে বিবিসির ফারসি বিভাগের রানা রহিমপুর এক রিপোর্টে লিখেছিলেন, ইরানে এই ‘সাদা বিয়ে’র প্রচলন এতটাই বেড়ে গেছে যে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতি দিয়ে এ ব্যাপারে তার ‘গভীর আপত্তি’ প্রকাশ করেছিলেন।

তার কার্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ মোহাম্মদী গোলপেগানির ইস্যু করা এক বিবৃতিতে কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল ‘কোহ্যাবিটেশন’ বা বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা নেবার ক্ষেত্রে যেন কোন দয়া প্রদর্শন করা না হয়’।

তাতে বলা হয়েছিল, ‘পুরুষ ও নারীর বিয়ে না করে একসাথে থাকা লজ্জাজনক। যেসব লোকেরা এ জীবন বেছে নিয়েছে তাদের একটি বৈধ প্রজন্মকে অবৈধ প্রজন্ম দিয়ে মুছে দিতে বেশি সময় লাগবে না’।

কিন্তু এসব সতর্কবাণী ইরানের তরুণ প্রজন্ম শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। এ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ইরানে কোন যুবক-যুবতী সাদা বিয়ে করবে এমনটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন এরকম অবিবাহিত দম্পতির সংখ্যা ক্রমশঃই বাড়ছে।

ইরানী নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় সাময়িকী ‘জানান’ ২০১৪ সালে এ বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। তবে এর কয়েক মাস পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে কর্তৃপক্ষ ‘বিয়ে না করে একসাথে থাকাকে উৎসাহিত করার’ অভিযোগে ম্যাগাজিনটি নিষিদ্ধ করে।

এ ব্যাপারে ঠিক কি করা যায় – এ নিয়ে ইরানি কর্তৃপক্ষ একটা দ্বিধায় আছে বলেই মনে হয়। ইরানের যুব বিষয়ক ডেপুটি মন্ত্রী মোহাম্মদ মেহদি তন্দগোইয়ান সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইরনাকে বলেছেন, ‘অবিবাহিত যুগলদের সন্তানদের একসময় তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দরকার হবে- যখন তারা স্কুলে ভর্তি হতে যাবে’।

তিনি সতর্ক করে দেন যে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হবার পরিণাম হবে বিপর্যয়কর।

ইরানে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায়ই ব্যয়বহুল হয়, আর এর খরচ দিতে হয় বরের পরিবারকে। আর বিয়ে ভেঙে গেলে স্ত্রীকে ‘মাহরিয়েহ’ হিসেবে যে অর্থ দিতে হয় – তাও দিতে হয় স্বামীকে। এর অংক হয় বেশ বড়, আর তা না দিতে পারলে জেলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই মনে করেন, ইরানে অনেক যুগলই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে চায় না এর কারণ হচ্ছে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের হার।

ইরানের একজন সমাজকল্যাণ সংস্থার একাংশের পরিচালক ফারহাদ আঘতার বলছেন, ইরানে প্রতি পাঁচটি বিয়ের একটি বিবাহবিচ্ছেদ হয়। সারা ইরানের মধ্যে রাজধানী তেহরানে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি।

ইরানী সমাজবিজ্ঞানী মেহেরদাদ দারভিশপুর – যিনি এখন সুইডেনে থাকেন – বলছিলেন, ‘এটা বলতেই হবে যে ইরানের সমাজের অধিকতর ধার্মিক অংশ বিয়ে ছাড়া নারীপুরুষের একসাথে থাকা গ্রহণ করে না’।

‘কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই ইরানের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধীরে ধীরে ঐতিহ্যগত বিয়ের তুলনায় এটাকেই বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক এখন আর কোন ‘ট্যাবু’ নয়’, বলেন তিনি।

ইরানের আইনে বিয়ের বাইরে কোন নারী-পুরুষের শারীরিক সংস্পর্শ ঘটলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ – যার জন্য ৯৯টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তির বিধান রয়েছে।

একারণে যে যুগলরা এরকম সাদা বিয়ে করেছেন -তারা এটা নানাভাবে গোপন রাখেন যাতে লোকের চোখে তা ধরা না পড়ে।

ইরানের আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী মেহরাঙ্গিজ কারের কথায় ‘একটা বড় সমস্যা হলো, বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকাটা যেহেতু বেআইনি – তাই কোন সমস্যা হলে এসব যুগলদের আইনি সহযোগিতা পাবার সুযোগ নেই’।

‘সাদা বিয়ে করেছেন এমন কোন নারী যদি অত্যাচারিত হন তাহলে তিনি পুলিশের কাছে যেতে পারেন না, কারণ তাহলে তিনি ও তার সঙ্গী উভয়কেই ব্যাভিচারের দায়ে গ্রেফতার করা হবে’।

আমরা নতি স্বীকার করবো না

ইরানের এলিট সমাজ এসব ‘সাদা বিয়ের’ ফলে জন্ম নেয়া শিশুদের সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন – কিন্তু তারা এ বিষয়টা নিয়ে খুব কমই প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।

ইরানের একজন স্পষ্টভাষী এবং সংস্কারপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য হচ্ছেন পারবানেহ সালাহশুরি। তিনি গত সেপ্টেম্বর মাসে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, যে নারীরা বিয়ে না করে একসাথে আছেন – তারা গর্ভবতী হলে তাদের সামনে গর্ভপাত ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

কিন্তু মিজ সালাহশুরির এই মন্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ বলে আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করে অতিরক্ষণশীল ফারস নিউজ এজেন্সি।

ইরানের এস্টাব্লিশমেন্ট যুক্তি দিচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বিয়ের আগেকার নানা রকম জটিল সামাজিক রীতিনীতির কারণে অবিবাহিত ইরানীরা এখন সনাতনী ধর্ম-অনুমোদিত বিয়ে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

ইরানের তরুণ প্রজন্মকে বিয়েতে উৎসাহিত করতে চালু হয়েছে হামদানের মত ডেটিং এ্যাপ । বিয়ের প্রাথমিক খরচ মেটাতে সুদমুক্ত ঋণও দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হামেদানের বাসিন্দা ৩১-বছর বয়স্ক শিনা একে ‘পেইন কিলার’ বা ব্যথানাশকের সাথে তুলনা করছেন। ‘বাড়ি ভাড়া দিতে দিতে যে আমার ঘাড় ভেঙে যাচ্ছে – তার কি হবে?’, বলেন তিনি।

শিনা এক দশক ধরে তার সঙ্গী সাদেকের সাথে বসবাস করছেন। তিনি মনে করেন, এভাবে একসাথে থাকাটা হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ।

‘আমরা জোরপূর্বক করানো বিয়ের ব্যবস্থার কাছে নতি স্বীকার করবো না’, বলছেন তিনি, ‘আমরা দু-চারটি শপথবাক্য বিনিময় করতে অস্বীকার করছি বলে আমাদের সম্পর্কটা অবৈধ হয়ে যাবে- এটা কেমন করে হয়?’

ইরানের সামাজিক মাধ্যমে বিয়ে-ছাড়া একসঙ্গে থাকার জনপ্রিয়তা বাড়ছে

ইরানের সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো খুবই প্রাণবন্ত, এবং সেখানে বিয়ে-ছাড়া একসঙ্গে থাকার জনপ্রিয়তা খুবই স্পষ্ট। এতে আরো বোঝা যায় যে এধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে।

টেলিগ্রাম মেসেজিং এ্যাপে অনেকগুলো চ্যানেল আছে যেখানে ‘সিঙ্গেল’ ইরানীরা তাদের সঙ্গী খুঁজে নেন।

একটি চ্যানেল আছে যার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৪৫,০০০এরও বেশি। এগুলোতে একজন সঙ্গী পাবার আশায় ইরানীরা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেন।

কিন্তু ইরানের কট্টরপন্থীদের মধ্যে এর বিরোধিতার কারণে এসব ভার্চুয়াল কমিউনিটির ভাগ্য অনিশ্চয়তার সূতোয় ঝুলছে।

এবছরই ইরানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেশটিতে ক্ষমতার ওপর রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণ জোরালো হয়েছে।

গত মাসেই তিনি ইরানের ইন্টারনেটের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাকে সাইবারস্পেসের ‘স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা’কে অগ্রাধিকার দেবার আদেশ দিয়েছেন- যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় আগামীতে হয়তো নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করা হতে পারে।

ইরানের দেওয়ানি আইনের ১১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারের ফলে জন্মানো শিশু ব্যভিচারকারীর হতে পারবে না’। এর অর্থ হচ্ছে, সন্তানের পিতামাতা অবিবাহিত হলে তাদের দম্পতি হিসেবে সন্তানকে রাখার কোন অধিকার থাকবেনা, এবং জন্মনিবন্ধর সনদে শুধুমাত্র শিশুটির মা তার নাম লিপিবদ্ধ করার অনুরোধ করতে পারবেন।

ইরানের কর্তৃপক্ষ এভাবে জন্মানো শিশুদের একটি গোপন রেকর্ড রাখে, এবং এসব তথ্য ভবিষ্যতে তাদের কিছু কিছু চাকরিতে নিয়োগ পাবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

More News...

কোন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল?

৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত বাংলাদেশি জাহাজ