জিনাত নেছা
শুক্রবার বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এ দিনে সব কিশোরী এবং যারা মা হবেন কিংবা মা হয়েছেন তাদের জানাই কৃতজ্ঞতা। এ বিষয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে নারী অবহেলিত। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজ নারীর স্বাস্থ্য বিশেষ করে মাসিক কিংবা মাতৃস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সময়ের পালাবদলে আজ অনেক কিছুর বদল আমরা দেখতে পেলে ও নারীর ঋতুমতী হওয়া, মাসিক হওয়া বা মা হওয়ার সময় (গর্ভধারণ থেকে পরবর্তী) নারীর সুস্থতা, স্বাস্থ্য (শারীরিক কিংবা মানসিক) আজো অবহেলিত।
পরিবারের অন্য সদস্যরা যেমন এই সম্পর্কে অসচেতন, অজ্ঞ ঠিক তেমনি নারী নিজেও। এখনো একজন কিশোরী ঋতুমতী হলে তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না, রান্না ঘরে যেতে দেওয়া হয় না, মাছ খেতে দেওয়া হয় না। তেমনি মাসিকের জন্য স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহারও কম। কাপড় ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতিও অনেকের কাছে অজানা। মাসিক গোপনীয় বিষয়, তাই কাপড় শুকাতে হয় খাটের তলায়, গোয়াল ঘরে কিংবা গোপন কোনো জায়গায়। তা কোনো পুরুষ দেখলে ওই কিশোরী অসূচি হয়ে যাবে।এখনো নারীদের অপবিত্র হিসেবে ধরে নিয়ে গৃহস্থালি অনেক কাজ যেমন রান্নার চাল না ওঠানো, সকাল সকাল সবার সামনে না আসা, গোয়াল ঘরে না ঢোকা, জমিতে না যাওয়া-এগুলো আমাদের সমাজে প্রচলিত। এগুলো যে কুসংস্কার তা আমাদের সমাজ এখনো মেনে নিতে পারেনি। কিংবা নিতে চায়নি, চায় না। বরং নারীর মাসিককে লজ্জাজনক, অপবিত্র এবং গোপনীয় বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে চার দেয়ালে এ সময়ে নারীকে আটকে রাখা হয়। বাবা তো নয়ই বরং মাও কিশোরীকে এই সময় সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন না।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার খুব কম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এ জন্য অবশ্য দায়ী বর্তমান বাজার অর্থনীতি।ভালো মানের ১০টার একটা স্যানিটারি প্যাকেটের মূল্য ১২০ টাকা। তাহলে এ দরিদ্র জনগোষ্ঠী কীভাবে তার কিশোরী মেয়েকে এগুলো কিনে দেবে? মাসিকের কাপড় ব্যবহারের সঠিক নিয়মও তারা জানে না। যেমন তারা জানে না মাসিকের কাপড় কড়া রোদে শুকাতে হয়, সাবান দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হয়, ডেটল দিয়ে ধুতে হয়। আবার সংরক্ষণ করতে হয় শুকনা জায়গায় পলিথিনে রেখে, কোনো বাক্স বা নিরাপদ জায়গায়। একই কাপড় তিন মাসের বেশি ব্যবহার করা যায় না।
এগুলো না মানার কারণে নারীদের নানা রোগ যেমন জরায়ুতে চুলকানি, ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে জরায়ুতে অপারেশন করতে হচ্ছে, কেটে ফেলতে হচ্ছে, এমনকি ক্যানসার হচ্ছে। এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হলো পারিবারিক অশান্তি, নির্যাতন, ডিভোর্স কিংবা পরকীয়া।
একটা গল্প বলব। ছদ্মনাম (রিমা) দিয়ে। বিয়ে করেছে নতুন। বিয়ের আগে থেকে রিমার দীর্ঘদিন সাদা স্রাবজনিত সমস্যা ছিল। কিন্তু লজ্জার কারণে বাবা-মাকে বলতে পারেনি। মাকে একবার বলেছিল। মা কবিরাজের ওষুধ এনে খাওয়ানোর ফলে কিছুটা কমে যায়। বিয়ের পর আবার শুরু হয়। স্বামীকে না জানিয়ে রিমা মাকে জানালে মা আবার কবিরাজের কাছে যেতে বলে। কিন্তু রিমা বলে, কিছুদিন আরো দেখে যদি ভালো হয়ে যায়। অবশেষে স্বামীকে জানালে স্বামী বলে, মা যা বলেছে তাই করো।রিমা বুঝতে পারে স্বামী গুরুত্ব দিচ্ছে না। অগত্যা তিনি নিজে কবিরাজের কাছে যান। কবিরাজ গাছান্ত ওষুধ (গাছগাছড়ার শিকড় দিয়ে তৈরি) দেন। সেগুলো খেয়ে কমেনি বরং আরো বেড়ে যায় রিমার সমস্যা। যখন যৌন জীবনে সমস্যা শুরু হয়, ‘স্বামীজির’ তখন টনক নড়ে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বলে বেশি দেরি করে ফেলেছেন। অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে।
অপারেশন শেষ হয়ে সুস্থ রিমা বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় অন্য। তা হলো পারিবারিক। রিমার যেহেতু জরায়ু কেটে ফেলেছে সেহেতু সন্তান ধারণে সে অক্ষম হয়ে পড়ে। এমনকি সঙ্গমে তারা উভয়ে সুখ পায় না। তার স্বামী তাকে জানিয়ে দেয়, তোমাকে আমার ভালো লাগে না, তোমার সন্তানও হবে না, আবার সেক্সও করতে পার না। আমি তোমাকে নিয়ে সুখী নই। রিমা বুঝতে পারে না কী করবে। অনেক নির্যাতন, অপমান সহ্য করতে করতে একপর্যায়ে মাকে জানায়। তত দিনে রিমার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে ডিভোর্স হয় রিমার। (এটা আমার গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত একটা কেস)।
তাই নারীর মাসিক স্বাস্থ্য এবং মায়েদের মাতৃস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কিশোরী বিয়ে বন্ধ করতে হবে। কিশোরী বিয়ে হলেই গর্ভবতী নারীর মাতৃস্বাস্থ্যে ঝুঁকি বেশি থাকে। মাকে পরিবারের সবারই পরিচর্যা করতে হবে। এ সব ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কুসংস্কার পরিহার করতে হবে। ক্লিনিক্যাল বার্থ বাড়াতে হবে। নিরাপদ ডেলিভারি বাড়াতে হবে। গর্ভধারণ থেকে পরবর্তী সব চেকআপ মাকে করাতে হবে। এ জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আরো বেশি সেবাদানে তৎপর হতে হবে।
আজ এই বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে সবার প্রতিজ্ঞা হোক এগুলো নারীর অধিকার। কোনো গোপন বা লজ্জার বিষয় নয়। পরিবার থেকেই এগুলোর শিক্ষা ও সচেতনতা সন্তানদের দিতে হবে। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
জিনাত নেছা: উন্নয়নকর্মী।