কষ্টে দিন কাটাছে লঞ্চ শ্রমিকদের

কষ্টে দিন কাটাছে লঞ্চ শ্রমিকদের

বরিশাল প্রতিনিধ : ঈদের আগে দিন-রাত মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দরসহ লঞ্চঘাটগুলোতে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় গত ৫ এপ্রিল থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় এবারে পিন পতন নিস্তব্দতা বিরাজ করছে দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দর ও লঞ্চঘাটগুলোতে।

এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে ব্যস্ততম বরিশাল নদীবন্দরেও এখন গোমটভাব বিরাজ করছে। ভাসমান ও পথশিশুদের পদচারণা ছাড়া যাত্রীদের যেমন পদচারণা নেই এখানে, সেই সঙ্গে নেই ঘাট শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা আর লঞ্চ শ্রমিকদের দৌড়ঝাপ। শুনতে পাওয়া যায় না লঞ্চের ইঞ্জিন ও সাইরেনের শব্দ।

বরিশাল নদীবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, বন্দরের সবকয়টা জেটি জুড়ে নোঙর করে পানিতে ঠায় ভাসছে অভ্যন্তরীণ ও দুরপাল্লা মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত লঞ্চ। যে লঞ্চগুলোতে দেখভালের জন্য কিছু কর্মচারী শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। আর চোঁখে মুখেই বিষন্নতার ছাপ নিয়েই দিনগুলো পার করে যাচ্ছেন তারা। রমজান মাস হওয়ায় বেশিরভাগ রোজা রাখছেন আর তারাবিসহ ওয়াক্তের নামাজগুলো লঞ্চেই জামাতের সহিত আদায় করছেন। খাওয়া-দাওয়া, নামাজ আদায়ের বাহিরে যে সময় থাকে, সেটুকু নিজেদের মধ্য গল্প করে কিংবা লুডু খেলে পার করছেন।

তবে এটা যে তাদের দায়িত্বেরই একটা অংশ তা জানালেন ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটের বিলাসবহুল এমভি মানামী লঞ্চের ডেক ক্রু ও বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহাটের বাসিন্দা মো. কাওছার।

তিনি বলেন, যে কোনো লঞ্চের প্রতিটি স্টাফই দায়িত্বশীল। লঞ্চ চলুক আর না চলুক কোম্পানির মালিক আমাদের ওপর ভরসা করেই কোটি টাকার এ সম্পদ পানিতে ভাসিয়েছেন। তাই লকডাউনে ঘাটে বেঁধে রাখা লঞ্চটির দেখভাল আমাদেরই করতে হবে। এটি যাত্রীবাহী বাসের মতো পার্কিং করে রেখে গেলেই হয় না, প্রাকৃতিক দুরে্যাগসহ যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। খোয়া যেতে পারে মালামাল। তাই ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে যেতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের লঞ্চে মোট যে স্টাফ আছে তারমধ্যে অর্ধেকের মতো লোক বর্তমানে বাড়িতে রয়েছে। বাকি অর্ধেক অর্থাৎ এক শিফট স্টাফ লঞ্চে আছি। লঞ্চ চলাচল না করায় কোম্পানিরও লোকসান হচ্ছে, ফলে বেতন-ভাতায় কিছুটা বিলম্ব হলেও পেয়েছি। কোম্পানির নিয়মে লঞ্চেই খাওয়া-দাওয়া চলছে, যদিও ব্যক্তিগত খরচ বেড়েছে। তাই বাড়ির মানুষগুলোকে এবারের ঈদে খুশি রাখতে পারছি না।

এ রুটের পারাবাত-১০ লঞ্চের সুকানি ও নড়াইলের বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেন জানান, প্রতিটি লঞ্চেই কিছু স্টাফ রয়েছেন, যারা লঞ্চগুলো দেখভাল করছেন। তবে ঘাটে নোঙর করা বরিশাল-ঢাকা রুটের অন্য দুটি লঞ্চের থেকে তাদের বেতন কিছুটা বেশি। যদিও ঘাটে অলস সময় পার করতে গিয়ে সার্বিক খরচ কিছুটা বেড়েছে।

তিনি বলেন, লকডাউন আর বেতনের জটিলতায় সময়মতো টাকা পাঠাতে না পারায় বাড়িতে স্বজনরা কোনাভাবে দিনপার করছে। দায়িত্বের জায়গা থেকে এবং লকডাউনের কারণে বাড়িতে যেতে পারিনি, তাই এবারের ঈদ লঞ্চেই কাটাতে হবে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে যেতেও পারছি না।

এসব লঞ্চগুলোর অন্য স্টাফরা জানান, লঞ্চ স্টাফদের বেতন আহামরি বেশি নয়, তবে লঞ্চ চললে কোম্পানি থেকে যেমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনি যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া বকশিসসহ বিভিন্ন কাজে বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে। তবে লঞ্চ চলাচল বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এসব সুযোগ বন্ধ রয়েছে। যারা লঞ্চে আছেন তাদের অনেকে বেতন পেয়েছেন বোনাস পাননি, আবার অনেকে এখনো বেতন পাননি। আর যারা বাড়িতে রয়েছেন তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। এছাড়া লঞ্চ চলাচল না করায় কলম্যান, ঘাট শ্রমিক, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও খারাপ দিন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ তো মানুষের কাছ থেকে হাত পেতেও সাহায্য নিচ্ছেন, আবার কেউ ধারসহ বিভিন্ন কারণে দেনাগ্রস্ত হচ্ছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের বাহিরে পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি ও ভোলার লঞ্চ শ্রমিকদের অবস্থাও করুন।

তারা জানান, লকডাউনে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, কিন্তু বাস্তবতায় লঞ্চের শ্রমিকরা কিছুই পায়নি।

ভোলার ইলিশা থেকে ঢাকা নৌ-রুটে চলাচলকারী লঞ্চ দোয়েল পাখির মাস্টার হোসেন আলীর মতে অমানবিক ও অর্বননীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে এবারের ঈদ কাটবে লঞ্চ শ্রমিকদের। যেমন কাজ নেই, তেমনি কোনো সহায়তাও নেই।

নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটে বাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহন চলছে, ট্রাক-পিকআপ ভ্যানসহ মালবাহী যানবাহনে যাত্রী টানা হচ্ছে, নদীতে ফেরি, ট্রলার, স্পিডবোট চলছে, শুধু চলতে পারছেনা লঞ্চ। ঈদকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে মানুষ ঠিকই বিভিন্ন পরিবহনে চেপে গাদাগাদি করে বাড়িতে আসছে, তবে মনে হচ্ছে খালি লঞ্চেই করোনা ছড়ায়। অথচ লঞ্চ বন্ধ থাকায় এর শ্রমিকসহ, ঘাট শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাই কষ্টে আছেন, তারা কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন সে খোঁজও কেউ রাখছেন না। আর মালিক পক্ষ থেকে যা সহায়তা লঞ্চ শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে তাও অপ্রতুল।

লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, করোনার প্রথম ধাক্কাই সামলে উঠতে পারেননি লঞ্চ মালিকরা। এরপরপরই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বিধি নিষেধে লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও বেতনসহ শ্রমিকদের সহায়তা দিতেও মালিকরা চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লঞ্চ শ্রমিকদের একটা তালিকা পাঠানো হয়েছে। আশা করছি সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে।

এদিকে, তালিকা করে বরিশালে লঞ্চ ও পরিবহন শ্রমিকদের সহায়তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহ আলম, নৌ-শ্রমিকদের প্রণোদনার জন্য সরকারের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

More News...

সোনার দাম আবার বাড়লো, ভরি ১ লাখ ১৯ হাজার ৪২৮ টাকা

ওবায়দুল কাদেরের মস্তিষ্ক অলস-হৃদয় দুর্বল : রিজভী