করোনার ভারতীয় ধরন রোখার চেষ্টা…

করোনার ভারতীয় ধরন রোখার চেষ্টা…

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় প্রতিবেশী ভারতের অবস্থা ভয়াবহ—মৃত্যু ও শনাক্তে নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে প্রতিদিন। দেশটিতে এবারের পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে দায়ী করা হচ্ছে কভিডের ‘ডাবল’ বা ‘ট্রিপল মিউটেশন’ ভেরিয়েন্টকে।

অত্যন্ত বিপজ্জনক সেই ধরন বাংলাদেশে যাতে আসতে না পারে, সে জন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল অব্যাহত থাকবে। আর আকাশপথে গত ১৪ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
গতকাল রোববার দুপুরে ঢাকায় একটি আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠকে সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান। এর পরপরই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য মৌখিকভাবে সীমান্তে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়।

রাতে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পররাষ্ট্রসচিবের সভাপতিত্বে গতকাল অনুষ্ঠিত আন্ত মন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২৬ এপ্রিল (আজ) সকাল ৬টা থেকে ৯ মে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ থাকবে। চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছে এবং ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনের কম আছে—এমন বাংলাদেশি নাগরিকরা বেনাপোল, আখাউড়া ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরতে পারবে। তবে তাদের অবশ্যই নয়াদিল্লি, কলকাতা বা আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের অনুমতি এবং বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ‘কভিড নেগেটিভ’ সনদ থাকতে হবে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর তাদের অবশ্যই দুই সপ্তাহ প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ভারত থেকে পণ্যবাহী যানবাহন বাংলাদেশে প্রবেশের আগে সীমান্তে অবশ্যই পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চালক ও তাঁর সহকারীদের কঠোরভাবে কভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। স্থলসীমান্তগুলো বন্ধ থাকার সময় দুই দেশের মধ্যে রেলপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আলোকে নয়াদিল্লি, কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশন ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবে।

এদিকে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ভারতীয় সম্প্রদায়কে জানিয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আগামী ১৪ দিন বাংলাদেশ থেকে স্থলসীমান্ত পথে ভারতে প্রবেশ স্থগিত করার বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয়দের মধ্যে যারা ভারতে যেতে চায়, তাদের ভারতীয় হাইকমিশন সহযোগিতা করবে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রক্রিয়া বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। এদিকে সীমান্ত বন্ধ করা হলেও দেশে চলমান লকডাউন শিথিল করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গতকাল থেকে দোকানপাট, বিপণিবিতান, শপিং মল খুলে দেওয়া হয়েছে। গণপরিবহনকর্মীরা এ সপ্তাহ শেষে আবারও কাজে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চলতি বিধি-নিষেধ (লকডাউন) আগামী বুধবার পর্যন্ত চলার পর প্রত্যাহার বা শিথিল হতে পারে। এতে করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতে কভিডে মৃতের সংখ্যা এতই বাড়ছে যে শ্মশানে চিতার আগুন নিভছেই না। কভিডের ‘ডাবল’ বা ‘ট্রিপল মিউটেশন’ ভেরিয়েন্টের কারণে দেশটিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। কিন্তু এর পরও পরিস্থিতি ভারতের মতো গুরুতর নয়। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের মতো বিপর্যয়ে না পড়তে কভিডের ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশন ভেরিয়েন্ট বা করোনার ভারতীয় ধরন ঠেকানোর ওপর জোর দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য তাঁরা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করারও পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের দাবি উঠেছিল রাজনৈতিক মহলেও। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে বিপদ আঁচ করে সীমান্ত বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, গত বছর মার্চ মাসে কভিড মহামারি শুরুর পরপরই ভারত তার ইস্যু করা সব ভিসা স্থগিত করে। গত বছরের শেষ দিকে ‘এয়ার বাবল’ ব্যবস্থা চালু হলে ভারত আবার ভিসা দেওয়া শুরু করে। তবে পর্যটক ভিসা পুরোপুরি বন্ধ আছে। জরুরি চিকিৎসাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিবেচনা করেই ভিসা ইস্যু করছিল ভারত। গত ১৪ এপ্রিল ‘লকডাউন’ শুরুর পর থেকে সেটি কার্যত বন্ধ আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এসব দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, গত বছরের মার্চ থেকেই বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত প্রায় বন্ধ আছে। জরুরি প্রয়োজনে স্বল্পসংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করত। সেটিও এখন বন্ধ হবে।

দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি

এদিকে দেশে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার ভেরিয়েন্টের পর ভারতীয় ও নাইজেরিয়ার ভেরিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ভারতের ট্রিপল মিউটেশন বা বেঙ্গল ভেরিয়েন্ট নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে। যুক্তরাজ্যসহ আরো কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত করা যায়নি বা শনাক্ত হয়নি। তবে দেশে এরই মধ্যে নাইজেরিয়ার ভেরিয়েন্টের (বি.১.৫২৫) অস্তিত্ব মিলেছে। দুটি বিভাগ থেকে মার্চ ও এপ্রিলে সংগ্রহ করা নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে এই ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে শনিবার গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটার (জিআইএসএইড) ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।

নাইজেরিয়ার ভেরিয়েন্ট খুব বেশি বিপজ্জনক নয় বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। কিন্তু ভারতীয় ভেরিয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাতে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট দেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘এটা প্রমাণিত হয়েছে যে দেশে লকডাউন পুরোপুরি পালন না হলেও যতটুকু হয়েছে তাতেই সংক্রমণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের ভেরিয়েন্ট নাকি সাউথ আফ্রিকার ভেরিয়েন্ট সেটি মুখ্য বিষয় নয়। এখন যদি আবার এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে সব কিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সেই সুযোগে পাশের দেশে যে শক্তিশালী ভেরিয়েন্টের বিস্তার ঘটছে, সেটি যদি দেশে ঢুকে পড়ে তবে সংক্রমণ আগের চেয়েও বহুমাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি দেশের মানুষকেও অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে। ’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘নাইজেরীয় ভেরিয়েন্ট নিয়ে আমার মনে হয় না তেমন কোনো উৎকণ্ঠার কারণ ঘটবে, বরং আমাদের জন্য ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে পাশের দেশের শক্তিশালী ভেরিয়েন্ট। এটা যদি আমরা যথাযথভাবে ঠেকাতে না পারি, তাহলে দেশের সংক্রমণ এখন যেভাবে নিচে নেমে আসছে, সেটা ধরে রাখা বড় কঠিন হয়ে পড়বে; উল্টো আগের চেয়েও বিপজ্জনক মাত্রায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ’

প্রায় একই ধরনের উদ্বেগের কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল হাসান। তিনি গতকাল বলেন, ‘ভারতে যে অবস্থা চলছে, তা আমাদের জন্য সত্যিই উদ্বেগের। কারণ যুক্তরাজ্য কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের জেনেটিক্যালি অনেক পার্থক্য থাকলেও ভারতের মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে আমাদের তেমন পার্থক্য নেই। ফলে ওই ভেরিয়েন্ট আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়াবহ পরিণতি ঘটাতে পারে। এ জন্যই আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছি। ’

সীমান্ত বন্ধ, দেশে শিথিল হচ্ছে লকডাউন

এদিকে সীমান্ত বন্ধ করা হলেও দেশে লকডাউন শিথিল করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। দোকানপাট খুলে গেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, লকডাউনের পরে গণপরিবহন চলাচলে সুযোগ দেওয়া হলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তা না হলে সরকার আবারও কঠোর লকডাউন দিতে বাধ্য হবে।

অন্যদিকে লকডাউন পরিস্থিতি মূল্যায়নে আবারও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডেকেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আজ সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এই বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লকডাউন পরিস্থিতি পর্যায়ক্রমে শিথিলের ইঙ্গিত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দেওয়া হচ্ছে। দোকান, শপিং মল খোলা হয়েছে। এখন পুরোপুরি সচল করে দেওয়া হবে, নাকি কিছুটা রাখঢাক করে চলা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় সরকার। বৈঠকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাও থাকবেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, স্বাস্থ্যের কর্মকর্তার মুখে অসহায়ত্ব

কভিড পরিস্থিতি নিয়ে সবাইকে সচেতন হতে হুঁশিয়ার করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণ সম্পর্কে সচেতন না হলে সামনে আবার করোনার তৃতীয় ঢেউ চলে আসবে এবং তৃতীয় ঢেউ আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে। এ কারণে করোনার হাত থেকে বাঁচতে চাইলে দেশের প্রত্যেককে করোনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

সরকার যখন বিধি-নিষেধ শিথিল করছে, তখন রীতিমতো অসহায় সুর ধ্বনিত হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত সংবাদ বুলেটিনে। গতকালের বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আমাদের চিত্র পাশের দেশের মতো হয়ে যেতে পারে। আমরা যদি ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশনের মধ্যে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের অবস্থা কী পরিমাণ ভয়ংকর হবে সেটা চিন্তা করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাই। ’

বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় সরকার ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শর্তসাপেক্ষে তিন দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নামিয়ে এনেছে। বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘কোনো মানুষের কোয়ারেন্টিন করতে হলে সেটা হতে হবে ১৪ দিন। ১৪ দিনের নিচে কোয়ারেন্টিন সম্ভব নয়। কিন্তু শুধু কোয়ারেন্টিন পালন করানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একমাত্র অধিদপ্তর নয়, এখানে আরো অনেক অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। ’

More News...

৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া

কোন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল?